পাবনার ঈশ্বরদীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রেলওয়ে সরকারি চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ। এখানে লেখাপড়া করে ভারতের বরেণ্য কবি শঙ্খ ঘোষের মতো সাহিত্যিক যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি দেশবরেণ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কামরুল ইসলামের মতো প্রাক্তন ছাত্র অর্জন করেছেন স্বাধীনতা পুরস্কার। অথচ শতবর্ষী এ প্রতিষ্ঠানে ২১ পদের বিপরীতে প্রধান শিক্ষকসহ তিনজন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। এতে ধুঁকে ধুঁকে চলছে ষষ্ঠ থেকে দশম পর্যন্ত পাঁচটি শ্রেণির প্রায় ২০০ শিক্ষার্থীর পাঠদান।
তিন শিক্ষকের মধ্যে প্রধান শিক্ষক ছাড়া একজন সহকারী শিক্ষক এবং একজন শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক রয়েছেন। তবে সংকটের কথা শুনে প্রাক্তন শিক্ষার্থী ডা. কামরুল ইসলাম ব্যক্তিগত উদ্যোগে চারজন অতিথি শিক্ষক নিজে বেতন দিয়ে রেখেছেন। আর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পাকশী রেলওয়ে কলেজের কয়েকজন শিক্ষককে মাঝেমধ্যে এনে পাঠদানের ব্যবস্থা করে জোড়াতালি দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার চেষ্টা করছেন।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন পাকশী রেলওয়ে কলেজের অধ্যক্ষ মোস্তফা ইমরুল কায়েস পারভেজ। তিনি বলেন, সপ্তাহে দু’দিন আইসিটি, বাংলা ও পদার্থবিজ্ঞানের তিনজন শিক্ষক কলেজের ক্লাসের ফাঁকে বিদ্যালয়ে গিয়ে পাঠদান করাচ্ছেন। শিক্ষক সংকটের কারণে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অনুরোধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রধান শিক্ষক কামরুল ইসলামের ভাষ্য, শিক্ষক সংকটের কারণে প্রধান শিক্ষক হয়েও দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে তাঁকেও পাঠদান করাতে হচ্ছে।
বিদ্যালয়ে যাতায়াতের রাস্তাও ভেঙে খানাখন্দে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। হেঁটেও ঠিকমতো আসা-যাওয়া করতে পারেন না শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। প্রায়ই ছাত্রদের বাইসাইকেল নষ্ট হচ্ছে। বৃষ্টির দিনে কাদাপানিতে একাকার হয়ে যায়। বিদ্যালয়ে আসার সময় রাস্তার কাদাপানিতে অনেক শিক্ষার্থীর কাপড় নোংরা হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে তাদের ফিরে যেতে হয় বাড়ি।
চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের দশম শ্রেণির ছাত্র মো. আবদুল আওয়াল খানের কথায়, শিক্ষকস্বল্পতার কারণে প্রায়ই ক্লাস মিস হয়। অনেক সময় বিদ্যালয় থেকে ফিরে যেতে হয়। নবম শ্রেণির ছাত্রী রিয়া খাতুনের ভাষ্য, ‘কলেজের স্যাররা আমাদের যেভাবে পড়াতে চান, তা আমাদের বুঝতে সমস্যা হয়। একেক দিনে একেক স্যারকে পড়া দিতেও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।’ দশম শ্রেণির ছাত্রী কুলসুম আরা জানায়, বিদ্যালয়ে শিক্ষার ভালো পরিবেশ থাকলেও শিক্ষক না থাকায় তারা পিছিয়ে পড়ছে।
সরেজমিনে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে গিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানের বয়স শতবর্ষ অতিক্রম করতে যাওয়ায় উদযাপনের ব্যাপক প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘প্রাক্তনী’র উদ্যোগে আগামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বর আয়োজন করা হয়েছে দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের। পাঁচ হাজারের বেশি প্রাক্তন শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে রেলওয়ে ফুটবল মাঠে এ আয়োজন করা হচ্ছে।
একদিকে পাকশীজুড়ে চলছে চন্দ্রপ্রভার শতবর্ষ উদযাপনের জন্য সাজ সাজ রব, অন্যদিকে শিক্ষা কার্যক্রমে চলছে দৈন্যদশা। এ অবস্থায় প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে, শতবর্ষ আয়োজনের আগেই এ প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে ঐতিহ্য রক্ষা করার। কর্মরত শিক্ষকরাও চান, বিদ্যালয়ের হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসুক শতবর্ষের এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে।
প্রাক্তন ছাত্র অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘১০০ বছরের প্রাচীন এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জৌলুস ম্লান হয়ে গেছে। স্কুলের দৈন্যদশা দেখে কষ্ট পাই।
প্রাক্তন ছাত্রদের সংগঠন ‘প্রাক্তনী’র সাধারণ সম্পাদক শিল্পপতি আশরাফ আলী খান মঞ্জু। তিনি বলেন, শতবর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে প্রাক্তনীর পক্ষ থেকে শিক্ষক সংকট নিরসনেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রাক্তন ছাত্র সাবেক এমপি সিরাজুল ইসলাম সরদারের ভাষ্য, যারা প্রাক্তন ছাত্র, তাদের সম্মিলিত উদ্যোগ নিয়ে শত বছরের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
শিক্ষক সংকট রয়েছে স্বীকার করে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার শাহ্ সুফী নূর মোহাম্মদ বলেন, দুই অতিথি শিক্ষক এবং রেলওয়ে কলেজের তিন শিক্ষক পাঠদান করাচ্ছেন। স্থায়ীভাবে শিক্ষক নিয়োগের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। শিগগিরই শিক্ষক সংকট নিরসন করা হবে।
Leave a comment