বিশ্বের বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনভূমি সুন্দরবন। নোনা জল ও কাদার এই রাজ্যেই বাস রাজকীয় সৌন্দর্যের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের। তবে দিন দিন বনে বাড়ছে মানুষের আনাগোনা। পালা দিয়ে বাঘের আক্রমণের ঘটনাও বাড়ছে। এমন অবস্থায়, বাঘ ও মানুষের সংঘাত রোধ করে স্থানীয় অধিবাসীদের সুরক্ষা দিতে চায় বনবিভাগ। চায় বিপন্ন বাঘদেরও মানুষের হামলা থেকে বাঁচাতে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই পৃথিবীর বৃহত্তম বাদাবনের একটি অংশে নাইলনের জালের বেড়া স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।
২০২২ সালের মার্চে শুরু হওয়া সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হবে। এর মাধ্যমে বাঘ ও বনজীবী মানুষকে একে-অন্যের বিচরণস্থল থেকে দূরে রাখতে চায় বনবিভাগ।
পরিবেশবাদী গণমাধ্যম মঙ্গাবে’কে বিষয়টি নিশ্চিত করেন সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন। তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে আমরা সুন্দরবনের ৬০ কিলোমিটারের বেশি এলাকায় পলিপ্রপিলিন জালের বেড়া স্থাপন করবো। আগামী অর্থবছর (২০২৩-২৪) থেকে বেড়া লাগানো শুরু হবে।”
সুন্দরবনই বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ যেখানে বাঘেরা থাকে। কিন্তু, মানুষের আনাগোনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে দিন দিন এই বাস্তুসংস্থানের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে চলেছে।
বন এলাকায় বাড়ছে জনসংখ্যা। স্থানীয় এসব স¤প্রদায় জীবিকার জন্য অনেকটাই বনের ওপর নির্ভরশীল। এতে অতি-আহরণ হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ। বাড়ছে বন কেটে জমি দখল। বিভিন্ন উপায়ে দূষিত হচ্ছে বনের এলাকা। মাছের ঘের ও চাষবাসেও বাদাবন আজ বিপন্ন।
আগে জলমগ্ন থাকায় বনের অনেক অংশ ছিল দুর্গম, নৌকা করে যাওয়ার উপায় থাকলেও গভীর বনে যাতায়াত সহজ ছিল না। কিন্তু, সুন্দরবনের নদী ও খালগুলোও পলি পড়ে ভরাট হচ্ছে। জাগছে নতুন চর। ফলে বনের বিশাল অংশে এখন সহজেই যেতে পারছে মানুষ।
আর এই বিষয়টিই বনবিভাগকে জালের বেড়া দিতে উৎসাহী করেছে। মোহসিন বলেন, মানুষ এখন অনায়সে জীবিকার জন্য বনে যেতে পারছে। অনেক সময় তারা বনের এলাকায় গরু-মহিষ চড়ায়। গৃহপালিত এসব প্রাণীকে দেখে আক্রমণে প্ররোচিত হচ্ছে বাঘ।
পোষা প্রাণীরা অনেক ধরনের রোগজীবাণু বহন করে। বাঘের এলাকায় মানুষ ও পোষা প্রাণীর বিচরণ বাড়ায় বিভিন্ন রোগব্যাধি বাঘের দেহে ছড়িয়ে পড়ছে।
মোহসিন বলেন, কুকুরের মতো কিছু পোষ্য প্রাণীর নানান রোগব্যাধি থাকে। তাই মানুষ ও তাদের পোষা প্রাণীর বনে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নদীতে জেগে ওঠা চর এবং খালের কিনারে নেটের বেড়া দেওয়া হবে।
সুন্দরবন অঞ্চলে বাঘ ও মানুষের সহাবস্থান বরাবরই ছিল শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে যেমন হয়, তেমনই অনিশ্চিত। তবু যতদিন বাঘেদের প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষিত ছিল, তখন কালেভদ্রে বাঘের আক্রমণে মৃত্যু ঘটতো মানুষের। কিন্তু, সা¤প্রতিক সময়ে বন্যপ্রাণির সাথে সংঘাতের ঘটনা তীব্রতর হয়েছে।
খাদ্যের সন্ধানে বাঘেরা বন-সংলগ্ন লোকালয়েও আসছে। গত ১২ জানুয়ারি ভোরের দিকে দু’টি বাঘ ভোলা নদী পাড়ি দিয়ে এসে বাগেরহাট পৌরসভার অধীন সোনাতলা গ্রামের কিছু এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। অবশ্য কোনো প্রকার দুর্ঘটনা ছাড়াই বাঘ দু’টি পরে বনে ফিরেও যায়। কিন্তু, অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই আতঙ্কিত গ্রামবাসী দলবদ্ধভাবে হামলা করে বাঘকে হত্যা করেছে। গ্রামে মানুষের গোয়ালে বাধা থাকে গবাদিপশু। সহজে সেগুলো শিকারের আশায় বাঘেরা নদী সাঁতরে গ্রামে চলে আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাতের আঁধারে তারা হানা দেয়। বন এলাকার হতদরিদ্র মানুষের সম্পদ সীমিত। তাই গবাদিপশুর ওপর হামলা তাদের যথেষ্ট ক্ষতিও করে।
বনবিভাগের আনুষ্ঠানিক তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে ৫০ বার মানব বসতিতে প্রবেশ করেছে সুন্দরবনের বাঘ। এসব ঘটনায় কখনো বাঘের প্রাণ গেছে, কখনো বা মানুষ বা গবাদিপশুর। ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪৯টি বাঘকে স্থানীয়রা হত্যা করেছে বলেও জানা যায় বনবিভাগের তথ্যমতে।
তবে মোহসিন জানান, বাঘ ও মানুষের এই সংঘাতে চলতি শতকের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৪৬টি বাঘ ও ৩০০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
২০১৫ সালের বাঘ শুমারিতে বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে মাত্র ১০৫টি বাঘ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ২০১৮ সালের জরিপে, ১১৪টি বাঘ থাকার অনুমান করা হয়। কিন্তু, ২০০৪ সালের জরিপে ৪৪০টি বাঘ থাকার অনুমান করা হয়েছিল। সেখান থেকে তাদের সংখ্যায় খাঁড়া পতনই উঠে এসেছে পরের জরিপগুলোয়।
হতে পারে বাঘ ভয়ঙ্কর; কিন্তু সে প্রকৃতির সন্তান। আদিম বন্যতাই তার স্বরূপ। বিপদও তার কম নয়। অবৈধ শিকার, মানুষের সাথে সংঘাত এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশে বাঘেদের একমাত্র আবাস সুন্দরবনে তাদের সংখ্যায় দ্রুত পতন হচ্ছে।
ভারতে জালের বেড়া কার্যকর হয় : বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে সুন্দরবনের অপর অংশ। সেখানকার সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান কর্তৃপক্ষ এর মধ্যেই বাদাবনের ৯০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে স্থাপন করেছে নাইলনের জালের বেড়া। তখন থেকেই মানব বসতিতে বাঘ আসার ঘটনা উলেখযোগ্য ভাবে কমেছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট- আইইউসিএন এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ইশতিয়াক উদ্দিন আহমদের মতে, একই কাজ বাংলাদেশে করলে গ্রামে বাঘ আসার ঘটনা বন্ধ হতে পারে। একই ভাবে মানুষের জন্যেও বনে যাওয়ায় বাধা তৈরি হবে। এভাবে বাঘ ও মানুষের সংঘাতের ঘটনা কমবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক ড. মনিরুল হাসান খান ছিলেন বাংলাদেশ টাইগার এ্যাকশন প্ল্যানের একজন সহ-লেখক। তিনি বেড়া দেওয়ার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এটি সমস্যার একটি কার্যকর সমাধান হতে পারবে। তারমতে, সংঘাত কমলে স্থানীয়দের মন থেকে বাঘের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিরসন হবে অনেকটাই। ফলে তারাও বাঘ সংরক্ষণে এগিয়ে আসবে।