২৫ মার্চ গনহত্যা দিবস
২৫ মার্চ গনহত্যা দিবস। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও সেদিনের নির্মম স্মৃতি ভুলতে পারেনি গনহত্যার শিকার শরণখোলা উপজেলার লাকুড়তলা গ্রামের হিন্দু পাড়ার বাসিন্দারা। আজও তাদের কান্না থামেনি। ওই গ্রামের বিরলা রানী (৮৫), শোভা রানী (৭০), উষা রানী (৭৫) সেদিনের তান্ডবের কথা মনে করে এখন ও ডুকরে কেঁদে ওঠে। এখন ও তাদের যুদ্ধ চলছে জীবনের সাথে।
সেদিনের স্মৃতি স্মরন করে কান্না ভেজা কন্ঠে তারা বলেন, রাজাকার বাহিনী আমাদের হিন্দু গ্রামে ঢুকে প্রথমে সব বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের লেলিহান শিখায় ভয়ে আতংকে আমরা বাড়ি ঘর ছেড়ে ঝোপঝাড় বাগানের মধ্যে লুকিয়ে পড়ি। এ সময় রাজাকাররা হুােিসল বাঁশি বাজিয়ে লুটপাট চালায় । আমাদের খুজতে থাকে। যে সব পুরুষকে তারা খুজে পায় তারা আজ আর কেউ বেঁচে নাই।
সেদিন আমাদের গ্রামের মহানন্দ সমদ্দার, মনিন্দ্র সাধক, বিমল সাধক, অটল কুলু, মনোরঞ্জন কুলু, গোপাল চন্দ্র হাওলাদার, ক্ষিরোধ বিহারী কুলু ও অনন্ত হাওলাদার সহ আরও অনেক কে বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়।
বিরলা রানী বলেন, পুরুষদের খুঁজতে গিয়ে রাজাকারা আমাকে ধরে ফেলে। রাইফেল দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করে। অশ্লীল গালিগালাজের পর তারা আমার সিঁথি থেকে সিদুর মুছে দেয়।
উষা রানী সেদিনের তান্ডবের কথা মনে করে বলেন, কোন মানুষের জীবনে যেন এমন দিন না আসে। সে দিনের কথা মনে পড়লেও গা শিহরে ওঠে।
শোভা রানী বলেন, সেদিন রাজাকাররা আমার পিতা মহানন্দ সমদ্দার আর আমার স্বামী মনিন্দ্র সাধক কে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যার পর তাদের লাশ লাকুড়তলার খালে ভাসিয়ে দেয়। একই দিনে আমি আর আমার মা মানকুমারীর সিঁথির সিদুর মুছে যায়। একই দিনে বিধবা হয়ে যাই মা ও মেয়ে।
কথা বলতে গিয়ে বার বার বিবর্ন কাপড়ের আচলে চোখ মুছেন শোভা রানী। বলতে থাকেন, তার জীবনের ৫০ বছরের কষ্ট গাথা। মায়ের সাথে আমার কোলের দু-বছরের মেয়ে সুর বালা কে নিয়ে পালিয়ে প্রথমে তাফালবাড়ী, পরের দিন বগীতে পৌছাই। সেখানে অনেকের সাথে নৌকায় করে ভারতের উদ্যেশ্যে পাড়ি জমাই। নৌকায় প্রায় ১ মাস আমাদের ভাঁসতে হয় জলে আর জঙ্গলে। কত সময় যে না খেয়ে থাকতে হয়েছে তা মনেও করতে পারছিনা। কষ্টে বুক ভেঁসে যায়।
বাড়ীতে রাজাকাররা লুটপাট করে টাকা পয়সা সোনাদানা নিয়ে যাওয়ায় প্রায় খালি হাতে নৌকায় উঠতে হয়। খাবারের অভাবে দুই বছরের শিশু সুর বালার সে কষ্ট আজও ভুলতে পারিনা।
বুক ভরা নিশ^াস ছেড়ে শোভা রানী আরও বলেন, আমার বাবাকে হত্যা করায় আমার মা মানকুমারী আমাদের ৫ টি ভাই বোনকে যেমন অভাব অনটনে বড় করেছেন। ঠিক তেমনি আমার মেয়ে সুর বালাকে পিতৃ ¯েœহ ছাড়াই অভাব অনটনের মধ্যে বড় করেছি। আজ তার বয়স ৫২ বছর। ৫০ বছরে ঠিক আমারই মত পিতা হারানোর শোক নিয়ে বেড়ে উঠেছে সে।
সুরবালার স্বামী শান্তি রঞ্জন বলেন, অভাব অনটনের সংসারে আমাদের ৪ সন্তানের মধ্যে ৩ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। একমাত্র ছেলে পলাশ দিনমজুর।
বয়সের ভারে রোগাক্রান্ত শোভা রানী বলেন, বাবা মারা যাওয়ায় অভাবের কারনে ২ ভাই দ্বিজেন আর বিজেন অনেক আগেই দেশ ছেড়েছেন। অন্য ২ ভাই পিজুশ আর ষড়ানন সমদ্দার অভাবের সাথে যুদ্ধ করছেন।
স্বাধীনতার ৫০ বছরেও তাদের এসব পরিবারের খবর কেউ নেয়নি বলে অভিযোগ তাদের। বিরলা, শোভা ও উষা রানীদের ক্ষোভ যেন একই। দেশের জন্য সর্বশ^ হারিয়ে তারা আজ অসহায়। যুদ্ধ না করে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা ও বীরঙ্গনা তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। গনহত্যার শিকার কেউ কেউ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়ে সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন। অথচ বাড়ী ঘর, সহায় সম্পদ ও আপনজন হারিয়েও তাদের গ্রামের কারো ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। এখনও তারা যুদ্ধ করছেন জীবনের সাথে।
শরণখোলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও যুদ্ধকালীন ইয়াং অফিসার হেমায়েত উদ্দিন বাদশা বলেন, গণহত্যার শিকার কেউ কেউ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হয়ে সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। গণহত্যার শিকার সকল পরিবারকে এ সুবিধা দেয়া উচিত।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার এম. এ খালেক বলেন, গণহত্যায় যারা আপনজন হারিয়েছেন, তাদেরকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া উচিত। তাদের জন্য নূন্যতম কোন সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে বিবেচনা করা যেতে পারে।