ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি যে বিএনপিতে আটকে গেছে, তা পুরোপুরি স্পষ্ট। রাষ্ট্রপতির অপসারণ প্রশ্নে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, অন্তর্বর্তী সরকার এবং জামায়াতে ইসলামী যেখানে একই সরলরেখায় দাঁড়িয়েছে; সেখানে বিএনপি কেন বেঁকে বসল! এমন প্রশ্ন দেশের মানুষের মনে মনে।
বিএনপি নেতারা সাংবিধানিক ‘শূন্যতা’ তৈরির কথা খোলামেলা বললেও ভেতরে ভেতরে রাজনৈতিক ‘ষড়যন্ত্রের গন্ধ’ পাচ্ছে দলটি। আদতে এই শঙ্কা থেকেই রাষ্ট্রপতির পক্ষে দলটির ‘কঠোর’ অবস্থান। এ পরিস্থিতিতে যে কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ মোকাবিলায় সর্বোচ্চ সতর্কতা ও দৃঢ় অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
দলটির নীতিনির্ধারক নেতাদের প্রশ্ন, সংবিধানের কোন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা হবে? কী উদ্দেশ্যে সরানো হবে? এই অপসারণ দেশ ও জনগণের জন্য ইতিবাচক, নাকি নেতিবাচক হবে? রাষ্ট্রপতিকে সরানোর উদ্যোগের সঙ্গে শুধু কি ছাত্ররা জড়িত, নাকি পর্দার আড়ালে অন্য কেউ খেলছে? এসব বিষয়ে আরও পর্যালোচনা করবেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। একই সঙ্গে সমমনা দল ও জোট নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে নেওয়া হবে মত। সবার মনোভাব বিশ্লেষণ করে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পরই দলীয় অবস্থান আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় হবে– এমন কিছু বিএনপির কাছে সন্দেহাতীত প্রমাণিত হলে রাষ্ট্রপতির অপসারণের প্রশ্নে তাদের অবস্থান অনড়ই থাকবে।
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবির বিষয়ে বিভিন্ন দলের সঙ্গে সংলাপ করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। গত শনিবারের বৈঠকে দলীয় ফোরামে আলোচনার পর রাষ্ট্রপতি প্রশ্নে তাদের অবস্থান তুলে ধরার কথা বলেছে বিএনপি। যদিও দলটির নেতারা প্রতিদিনই অপসারণের বিপক্ষে নিজেদের মত তুলে ধরেছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল রোববারও যুবদলের এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি অপসারণে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানের ফসলকে ঘরে তোলার জন্য বাংলাদেশের বিপ্লবকে যদি সংহত করতে হয়, তাহলে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় সবকিছু করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবিতে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকের পর বিএনপির অবস্থান কী? এ প্রশ্নে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপির অবস্থান তো আমরা এভাবে দেব না। আমাদের ফোরাম আছে, সেখানে আলোচনা করে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করব।’
অবশ্য গতকাল রাষ্ট্রপতি অপসারণের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেছেন, এটা একটা বড় সিদ্ধান্ত। এটাতে আমাদের যেমন তাড়াহুড়া করার সুযোগ নেই, তেমনি বেশি দেরি করার সুযোগ নেই।
বিএনপির নীতিনির্ধারক কয়েকজন নেতা সমকালকে বলেন, রাষ্ট্রপতিকে সরানোর ব্যাপারে এখন পর্যন্ত যতটুকু আঁচ করতে পেরেছি, তাতে ‘ষড়যন্ত্রের গন্ধ’ পাচ্ছি। এই ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা কারা জড়িত, তা জানার চেষ্টা করছি। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কেও জানার চেষ্টা চলছে। দেশে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করে কাউকে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে দেওয়া হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা জানান, জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতির অপসারণকে সমর্থন করলেও দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল সমর্থন করে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ সমকালকে বলেন, রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে দেশ ও জনগণের স্বার্থে সবাইকে ধৈর্য ধারণ করে মঙ্গলময় সিদ্ধান্তে পৌঁছা উচিত। যাতে গণঅভ্যুত্থানে জনগণের অর্জিত বিজয়ে কোনো কালিমা লেপন না হয়। ফ্যাসিবাদবিরোধীদের ঐক্য বজায় রাখতে হবে। আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে ভিন্ন কোনো পথও বেরিয়ে আসতে পারে।
দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী তৎপর
বিএনপির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা জানান, গণঅভ্যুত্থানের পর পরই প্রতিবিপ্লব ঘটানোর জন্য যেমন পরাজিত শক্তি তৎপর, তেমনি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীও নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রলম্বিত করে একটি অনির্বাচিত সরকারের মেয়াদকে দীর্ঘায়িত করতে চাইছে। সর্বশেষ এর সংযোজন ঘটেছে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনকে সরানোর ইস্যু সামনে আনার মাধ্যমে।
তারা বলেন, রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে একদিকে যেমন সাংবিধানিক সংকটের সৃষ্টি করা হবে, তেমনি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রলম্বিত করতে নানা অপতৎপরতা শুরু হবে। এর মধ্যে এমন একজনকে তারা রাষ্ট্রপতি বানাতে চাইবেন, যিনি নিজেও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করবেন। অথবা জাতীয় সরকার গঠনের মতো নতুন ইস্যু তৈরি করা হবে। মুষ্টিমেয় দলের সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনের দাবির মতো ওই জাতীয় সরকার গঠনেও জটিলতা তৈরি করে দেশে নতুন আরেকটি সংকট সৃষ্টি করা হতে পারে বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা।
গতকাল বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী উত্তরের এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। সংবিধানের কিংবা রাষ্ট্রীয় সংকট যদি হয়, সেই সংকটের পেছনে কোন শক্তি আছে, সেটা আমাদের আগেই বের করতে হবে। বিপ্লবের পর বিপ্লবের ফসল ছিনতাই হয়ে যায় নাকি, সেটা চিন্তা করতে হবে। তাই সংকট সামনে রেখে পতিত ফ্যাসিবাদ যাতে সুযোগ নিতে না পারে, সেই বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।
বিএনপি নেতারা জানান, রাষ্ট্রপতি নিয়ে সাংবিধানিক সংকটকেই তারা এ মুহূর্তে প্রাধান্য দিতে চাইছেন। তারা এই সংকট সৃষ্টির দায় নিতে নারাজ। অন্য সব ইস্যুর চেয়ে তারা গণতন্ত্র, নির্বাচন, ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ইস্যুতেই থাকতে চাইছেন।
দলটির নীতিনির্ধারক নেতারা আরও জানান, দেশে যত গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস রয়েছে, তার মধ্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সবচেয়ে সফল। এই আন্দোলনের ফলে স্বৈরাচার শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতাকর্মী পালিয়েছেন। জাতীয় ঐক্যের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে এই আন্দোলনে। তবে যে বিষয়টি সামনে রেখে দেশের ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, সেটাকেই গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছে। জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার খুব বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে না। অথচ এই দেশের জনগণ দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত, গণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত।
তারা বলছেন, শুরু থেকেই বিএনপি আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে রোডম্যাপের দাবি করছেন তারা। তবে সেসবে সরকারের গুরুত্ব কম। তারা সংস্কারের নামে একদিকে সময়ক্ষেপণ করার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে নানা ইস্যু তৈরি করে ছাত্রদের সামনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি করে পরিস্থিতি আরও জটিল করতে তৎপর একটি মহল।
তবে রাষ্ট্রপতি প্রশ্নে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে যাতে কোনো সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখছে বিএনপির হাইকমান্ড। এ অবস্থায় অন্য কোনো ফাঁদে পা না দিয়ে শুধু গণতন্ত্র ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ইস্যুই সামনে রাখার কৌশল নিয়েছে বিএনপি।
তুমুল গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালানো শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন কিনা, সে বিষয়টি নিয়ে আড়াই মাস পর বিতর্কের জন্ম দেন রাষ্ট্রপতি। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে মোঃ সাহাবুদ্দিন বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের কথা তিনি শুনেছেন, কিন্তু কোনো দালিলিক প্রমাণ তাঁর কাছে নেই। তাঁর ওই বক্তব্য প্রকাশ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি চাপে পড়েন। প্রথমে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল দাবি করেন, সাহাবুদ্দিন ‘মিথ্যা’ বলে শপথ ভঙ্গ করেছেন। তাঁর অপসারণ নিয়েও কথা বলেন উপদেষ্টা। এর পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবিতে মাঠে নামে।