হারাম আরবি শব্দ। অর্থ ‘নিষিদ্ধ’। এক কথায় কোরআন সুন্নাহ অনুযায়ী যেসব কাজ নিষিদ্ধ সেসব কাজকে হারাম বলা হয়। মুসলিমরা হারাম কাজে লিপ্ত হতে পারে না। যেসব নিষিদ্ধ কাজে মুসলমানদের উদাসীনতা বেশি, সেরকম ১০টি কাজ নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো।
১) বাদ্যযন্ত্র
আল্লাহ তাআলা দুনিয়া-প্রত্যাশীদের ব্যাপারে বলছেন, আর একশ্রেণির লোক আছে, যারা অজ্ঞতাবশত খেল-তামাশার বস্তু ক্রয় করে বান্দাকে আল্লাহর পথ থেকে গাফেল করার জন্য। (সুরা লুকমান: ৬)
এই আয়াতের শানে নুজুলে বলা হয়েছে, নজর ইবনে হারিস বিদেশ থেকে একটি গায়িকা বাঁদী খরিদ করে এনে তাকে গান-বাজনায় নিয়োজিত করল। কেউ কোরআন শ্রবণের ইচ্ছা করলে তাকে গান শোনানোর জন্য সে গায়িকাকে আদেশ করত এবং বলত মুহাম্মদ তোমাদেরকে কোরআন শুনিয়ে নামাজ, রোজা এবং ধর্মের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার কথা বলে। এতে শুধু কষ্টই কষ্ট। তার চেয়ে বরং গান শোনো এবং জীবনকে উপভোগ করো। (মাআরিফুল কোরআন: ৭/৪)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-কে উক্ত আয়াতের ‘লাহওয়াল হাদিস’-এর ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘তা হলো গান।’ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) একই কথা বলেন। তাবেয়ি সায়িদ ইবনে যুবাইর থেকেও অনুরুপ মত বর্ণিত হয়েছে। বিখ্যাত তাবেয়ি হাসান বসরি (রহ) বলেন, উক্ত আয়াত গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে, যা বান্দাকে কোরআন থেকে গাফেল করে দেয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির: ৩/৪৪১)
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল সাব্যস্ত করবে। (সহিহ বুখারি: ৫৫৯০)
শুধু গান বাজনা নয়, সাহাবায়ে কেরামগণ বাজনাদার নূপুর ও ঘুঙুরের আওয়াজও সহ্য করতেন না। নাসায়ি ও সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত আছে, একদিন হজরত আয়েশা (রা.)-এর নিকট বাজনাদার নূপুর পরে কোনো বালিকা আসলে আয়েশা (রা.) বললেন, খবরদার, তা কেটে না ফেলা পর্যন্ত আমার ঘরে প্রবেশ করবে না। অতঃপর তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, যে ঘরে ঘণ্টি থাকে, সেই ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না। (সুনানে আবু দাউদ: ৪২৩১; সুনানে নাসায়ি: ৫২৩৭) সহিহ মুসলিমে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ঘণ্টি, বাজা, ঘুঙুর হল শয়তানের বাদ্যযন্ত্র। (সহিহ মুসলিম: ২১১৪)
ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ি ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ) সকলেই গান-বাদ্যকে হারাম বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইমাম মালেক (রহ)-কে গান-বাদ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কেবল ফাসিকরাই তা করতে পারে। (কুরতুবি: ১৪/৫৫) ইমাম শাফেয়ী (রহ) বলেছেন, গান-বাদ্যে লিপ্ত ব্যক্তি হল আহম্মক। তিনি আরো বলেন, সর্বপ্রকার বীণা, তন্ত্রী, ঢাকঢোল, তবলা, সারেঙ্গী সবই হারাম এবং এর শ্রোতা ফাসেক। তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না। (ইগাছাতুল লাহফান ১/১৭৯; কুরতুবি: ১৪/৫৫)
২) মদপান ও জুয়া
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! মদ, জুয়া, পূজার বেদি ও ভাগ্যনির্ণায়ক শর হচ্ছে শয়তানের অপবিত্র কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও।’ (সুরা মায়েদা: ৯০)
আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘লোকেরা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলুন, দুটোর মধ্যেই আছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও; আর এ দুটোর পাপ উপকারের চাইতে অনেক বড়।’ (সুরা বাকারা: ২১৯)
৩) নিজের বা অন্যের ক্ষতিসাধন
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না; কিন্তু তোমাদের পরস্পরে রাজী হয়ে ব্যবসায় করা বৈধ; আর একে অপরকে হত্যা করো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।’ (সুরা নিসা: ২৯)
৪) সুদের উপার্জন ও সুদ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম
ইসলামে সুদের উপার্জন খাওয়া হারাম। সুদের সকল কার্যক্রমও হারাম। সুদের বিপরীতে মহান আল্লাহ বেচাকেনাকে হালাল করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা: ২৭৫)
সুদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নবীজি (স.) অভিশাপ দিয়েছেন। বর্ণিত হয়েছে, ‘যে সুদ খায়, যে সুদ খাওয়ায়, যে সাক্ষী থাকে এবং যে ব্যক্তি সুদের হিসাব-নিকাশ বা সুদের চুক্তিপত্র ইত্যাদি লিখে দেয় সবার প্রতি রাসুলুল্লাহ (স.) লানত করেছেন।’ (তিরমিজি: ১২০৬)
৫) পুরুষের রেশম ও স্বর্ণ ব্যবহার
জমহুর উলামায়ে কেরামের মতে, পুরুষের জন্য রেশমি পোষাক এবং স্বর্ণ ব্যবহার নাজায়েজ। এর উপর ইজমা রয়েছে। আলি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) একবার রেশমের পোষাককে ডান হাতে রাখেন এবং স্বর্ণকে বাম হাতে রাখেন। অতঃপর বলেন, এগুলোকে আল্লাহ তাআলা কেয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। (আবু দাউদ: ৪০৫৭)
৬) হস্তমৈথুন
আজকের বিশ্বে, যখন ইন্টারনেট সহজেই অ্যাক্সেসযোগ্য, তখন যে কেউ যেকোনো কিছু অনুসন্ধান এবং দেখার সুযোগ পাচ্ছে। এই খারাপ আসক্তির শিকার হচ্ছে যুবসমাজ। হস্তমৈথুন স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, এ কারণেই ইসলাম প্রতিটি মুসলমানের জন্য একে জিনা হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং নিষিদ্ধ করেছে। সুরা মুমিনুনের ৫ থেকে ৭ নম্বর আয়াত এবং সুরা নুরের ৩৩ নম্বর আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে, সকল সেক্সুয়াল অ্যাক্ট বা যৌনকর্ম হারামের অন্তর্ভুক্ত। অধিক সংখ্যক আলেমের মতে হস্তমৈথুনও এর অন্তর্ভুক্ত। (ইবনে কাসির)
তাছাড়া নবী (স.) বলেন, ‘হে যুবকগণ! তোমাদের মধ্য থেকে যে বিয়ে করতে পারে তার বিয়ে করে নেওয়া উচিত। কারণ এটি হচ্ছে চোখকে কুদৃষ্টি থেকে বাঁচাবার এবং মানুষের সততা ও চারিত্রিক পবিত্ৰতা রক্ষার উৎকৃষ্ট উপায়। আর যার বিয়ে করার ক্ষমতা নেই তার সাওম পালন করা উচিত। কারণ সাওম মানুষের দেহের উত্তাপ ঠাণ্ডা করে দেয়।’ (বুখারি: ১৯০৫, মুসলিম: ১০১৮)
এই হাদিসে হস্তমৈথুনের ইঙ্গিত করা হয়নি, বরং চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার জন্য রোজা রাখতে বলা হয়েছে। (ইসলাম কিউ)
৭) আল্লাহর নাম ছাড়া পশু জবাই
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যে জন্তু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় না তা তোমরা আহার করো না। কেননা তা গর্হিত বস্তু..।’ (সুরা আনআম: ১২১)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য জবাই করে তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ।’ (সহিহ মুসলিম: ৩৬৫৭)
৮) ট্যাটু বা উল্কি অঙ্কন
শরীরে ট্যাটু বা উল্কি আঁকা অধিকাংশ ফিকাহবিদদের মতে হারাম। (হাশিয়াতু ইবনে আবিদিন, খণ্ড: ৫, পৃষ্ঠা-২৩৯)
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম কাঠামো দিয়ে।’ (সুরা তিন: ০৪) অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তারা আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতি করবেই।’ (সুরা নিসা: ১১৯)
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেন, যেসব নারী নকল চুল ব্যবহার করে এবং যারা অন্য নারীকে নকল চুল এনে দেয়, যেসব নারী উল্কি অঙ্কন করে এবং যাদের জন্য করে, রাসুল (স.) তাদের অভিশাপ দিয়েছেন।’ (বুখারি: ৫৫৯৮; মুসলিম: ৫৬৯৩)
৯) আত্মহত্যা
আত্মহত্যার প্রবণতা ইদানীং বেড়ে গেছে। বিশেষ করে তরুণরা নানা কারণে এই ভয়ঙ্কর নেশায় মেতেছে। অথচ আত্মহত্যাকারীর চূড়ান্ত স্থান জাহান্নাম। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামেও তার সেই যন্ত্রণাকে অব্যাহত রাখা হবে। আর যে ব্যক্তি ধারালো কোনো কিছু দিয়ে আত্মহত্যা করবে, তার সেই যন্ত্রণাকেও জাহান্নামে অব্যাহত রাখা হবে।’ (বুখারি: ৪৪৬)
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আর যে কেউ স্বেচ্ছায় কোনো মুমিনকে হত্যা করবে, তার শাস্তি হবে জাহান্নাম। তন্মধ্যে সে সদা অবস্থান করবে এবং আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ ও তাকে অভিশপ্ত করেন। তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ (সুরা নিসা: ৯৩)
এ আয়াতে আত্মহত্যার বিষয়ও রয়েছে। বাহরুর রায়েকে এসেছে- ফতোয়ায়ে কাজিখানে কিতাবুল ওয়াকফে আছে, দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন নিজেকে হত্যা করেছে, আর দ্বিতীয়জন অন্যকে হত্যা করেছে, তখন যে নিজেকে হত্যা করেছে, তার পাপ বেশি হবে।’ (বাহরুর রায়েক, খণ্ড: ২, পৃ-২১৫)। কেননা অন্যকে হত্যা করলে আপোসের মাধ্যমে তাওবা করার সুযোগ থাকে; কিন্তু আত্মহত্যাকারীর জন্য তাওবার কোনো পথ থাকে না।
১০) স্ত্রীকে জোর জবরদস্তি করা
স্ত্রীকে ফোর্স করা বা জবরদস্তি করা সবচেয়ে বড় পাপের একটি। প্রিয়নবী (স.) আমাদেরকে আপনার স্ত্রীর সাথে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ হতে শিখিয়েছেন, এমনকি বলেছেন যে তাকে আপনার সেরা বন্ধু বানাও! ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা হলো—‘…স্ত্রীদের সঙ্গে সৎভাবে জীবন যাপন করবে…।’ (সুরা নিসা: ১৯)
নবী (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম, আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীদের নিকট সর্বোত্তম ব্যক্তি।’ (ইবনে মাজাহ: ১৯৭৭; তিরমিজি: ৩৮৯৫)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উক্ত ১০টি গুরুতর হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।