যুক্তরাষ্ট্রের ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ মঙ্গলবার শুরু হয়েছে। এ নির্বাচনে হয়তো কমলা হ্যারিস দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতিহাস গড়বেন অথবা ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নাটকীয় প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পাবেন, যা সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করবে।
ডেমোক্র্যাট দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস (৬০) ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প (৭৮) এই যুগের সবচেয়ে টানটান ও উত্তেজনাপূর্ণ নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রায় সমান সমান অবস্থানে রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিনগুলোতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী তাদের সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহিত করতে এবং দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যের (সুইং স্টেট) ভোটারদের কাছে টানতে নিরন্তর প্রচার চালান।
এবারের প্রচারণা অনেক নাটকীয় ঘটনার সাক্ষী হয়েছে। যেমন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জুলাই মাসে সরে দাঁড়ানোয় কমলা হ্যারিসের আকস্মিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রবেশ এবং ট্রাম্পের ওপর দুবার হত্যার চেষ্টা ও একটি ফৌজদারি দণ্ড। কিন্তু এত কিছুর পরও মতামত জরিপে কোনো পক্ষ স্পষ্টভাবে এগিয়ে নেই।
এদিকে প্রায় সাড়ে আট কোটির বেশি ভোটার আগাম ভোট প্রদান করেছেন।তবে মূল নির্বাচনের দিনেও লাখ লাখ আমেরিকান ভোট দিচ্ছেন।দীর্ঘ লাইন ভোটকেন্দ্রগুলোর বাইরে ভোর থেকেই লাইন দেখা গেছে, যেমন নর্থ ক্যারোলাইনার ব্ল্যাক মাউন্টেনে, যেখানে বন্যার কারণে একটি তাঁবুর নিচে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্য পেনসিলভানিয়ার এরি শহরেও ভোটারদের দীর্ঘ সারি দেখা যায়।হ্যারিসকে ভোট দেওয়ার পর মারশেল বেসন (৪৬) বলেন, এবার এখানে গতবারের চেয়ে অনেক, অনেক বেশি মানুষ এসেছে।
তিনি একটি প্রাথমিক স্কুলে ভোট দিয়ে ‘আই ভোটেড’ স্টিকার পরেন। তবে তিনি এ-ও বলেন, ‘আমরা এখন বিভক্ত এবং হ্যারিস শান্তির জন্য দাঁড়িয়েছেন। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বীর বক্তব্যগুলো সবই নেতিবাচক।’একই স্কুলে ট্রাম্প সমর্থক ডারলিন টেইলর (৫৬) বলেন, তার প্রধান ইস্যু ‘সীমান্ত বন্ধ করা’। তিনি আরো চার বছর মুদ্রাস্ফীতি, গ্যাসের উচ্চমূল্য ও মিথ্যাচার চান না বলেও জানান।
তিনি এ সময় ট্রাম্পের সমর্থনে নিজের বানানো একটি টি-শার্ট পরেছিলেন।
এদিন মার্কিন কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণের জন্যও ভোট হচ্ছে। হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের ৪৩৫টি আসন ও সিনেটের ১০০ আসনের মধ্যে ৩৪টি আসন রয়েছে দখলের প্রতিযোগিতায়।
এই নির্বাচনের ফল যদি মতামত জরিপগুলোর মতোই ঘনিষ্ঠ থাকে, তবে কয়েক দিন ধরে চূড়ান্ত ফল জানা না-ও যেতে পারে, যা বিভক্ত জাতির মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে পারে। বিশেষ করে ট্রাম্প যদি হারেন এবং ২০২০ সালের মতো ফল চ্যালেঞ্জ করেন, তবে সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য হোয়াইট হাউসের চারপাশে নিরাপত্তা বেড়া দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বাড়ছে। কারণ এই নির্বাচনের ফলের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, যেটিকে ট্রাম্প ‘প্রতারণা’ বলে উল্লেখ করেছেন।হ্যারিস ও ট্রাম্প মূলত সাতটি সুইং স্টেটে প্রায় সমানে সমান অবস্থানে রয়েছেন। সোমবার হ্যারিস তার প্রচারণার মূল লক্ষ্যবস্তু পেনসিলভানিয়াতে শেষ সমাবেশ করেন। ফিলাডেলফিয়ার বিখ্যাত ‘রকি’ সিনেমার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘গতি আমাদের পক্ষে।’ তবে তিনি এ-ও বলেন, ‘এটি হতে পারে ইতিহাসের অন্যতম কাছাকাছি প্রতিযোগিতা—প্রতিটি ভোটই গুরুত্বপূর্ণ।’
ইতিহাস গড়ার পথে ট্রাম্প প্রথম দণ্ডিত অপরাধী ও সবচেয়ে প্রবীণ হিসেবে প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রতিযোগিতায় রয়েছেন। তিনি নিজেকে দেশকে সংকট থেকে বের করে আনার একমাত্র সমাধান হিসেবে তুলে ধরেছেন। মিশিগানের গ্র্যান্ড র্যাপিডসে তার শেষ সমাবেশে ট্রাম্প বলেন, ‘আপনার ভোটে আমরা আমাদের দেশের প্রতিটি সমস্যার সমাধান করতে পারব এবং আমেরিকাকে, এমনকি বিশ্বকে নতুন গৌরবের উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব।’
অন্যদিকে ট্রাম্প সমর্থিত গর্ভপাত নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে হ্যারিস নারীদের অধিকার রক্ষায় জোর দিয়েছেন, যা ভোটারদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে ধরা হয়েছে। তবে তিনি ট্রাম্পের কথা উল্লেখ না করে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। যদিও আগের কয়েক সপ্তাহে তিনি সরাসরি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসেবে ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন।
ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন হলে ইতিহাস সৃষ্টি হবে। ১৮৯৩ সালে গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের পর এটি হবে দ্বিতীয়বারের মতো কোনো প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে আসা। তবে ট্রাম্প ফের ক্ষমতায় এলে আন্তর্জাতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। ইউরোপ ও ন্যাটোতে তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির জন্য উদ্বেগ বাড়ছে। এ ছাড়া বাণিজ্য অংশীদাররা তার ব্যাপক আমদানি শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি নিয়ে শঙ্কিত।
অন্যদিকে হ্যারিস জয়ী হলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী ও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত প্রেসিডেন্ট হবেন এবং প্রায় এক দশক ধরে মার্কিন রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকারী ট্রাম্প যুগের অবসান ঘটাবেন। ট্রাম্প ইতিমধ্যে বলেছেন, তিনি ২০২৮ সালে আর নির্বাচন করবেন না। তবে তিনি আবারও হারলে তা মেনে নেবেন না বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন। পাশাপাশি ভোট জালিয়াতির ভিত্তিহীন দাবি তুলে বলেছেন, তার ‘কখনোই হোয়াইট হাউস ছাড়ার কথা ছিল না।’