মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ আর সামরিক শাসন চায় না। একারণে দেশটির রাজপথে প্রায় প্রতিদিনই চলছে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ। দ্রুততম সময়ে গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমারের সেনাশাসকদের ওপর আন্তর্জাতিক চাপও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। অথচ এসবে যেন কোনও মাথাব্যাথাই নেই জান্তা সরকারের! তাদের মতে, ‘মিয়ানমারে তো কোনও অভ্যুত্থানই হয়নি’!
সম্প্রতি মিয়ানমারের হালচাল দেখতে গিয়েছিল মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের একটি দল। গত ৩১ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত দেশটির বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুন ও রাজধানী নেপিদোতে ছিলেন তারা। সেখানে কথা বলেছেন জান্তা সরকারের মুখপাত্র এবং সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে।
সফরের আগে মিয়ানমার জান্তা আশ্বস্ত করেছিল, সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে খবর সংগ্রহ করতে দেয়া হবে। তবে যাওয়ার পরে তারা ইয়াঙ্গুনের কোনও হোটেলে থাকতে চাইলেও তাদের নিয়ে যাওয়া হয় দেয়ালঘেরা একটি সামরিক এলাকায়। এরপর খুব সীমিত পরিসরে এবং কড়া নিয়ন্ত্রণের মধ্যে জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি পান তারা। ‘সাহায্য করতে’ একজন সামরিক দোভাষীও সঙ্গে দেয়া হয়েছিল, তবে পরে নিজেরাই অনুবাদ করেছে সিএনএন টিম।
নেপিদোতে সিএনএনের মুখোমুখি হয়েছিলেন মেজর জেনারেল জ মিন তুন। প্রায় এক ঘণ্টার সেই কথোপকথনে জান্তা সরকারের এ মুখপাত্র জোর গলায় দাবি করেন, সামরিক জেনারেলরা একটি ‘জালিয়াতি’র নির্বাচন তদন্ত করার মাধ্যমে দেশটিকে ‘রক্ষা করছেন’। তার মতে, রাজপথে বিক্ষোভকালে যে ৬০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তার পুরো দোষই ‘দাঙ্গাবাজ’ বিক্ষোভকারীদের।
একপর্যায়ে এ সেনা কর্মকর্তা এটিও বলেন, মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী নেত্রী অং সান সু চির বাবা যদি আজকের পরিস্থিতি দেখতেন, তাহলে মেয়েকে বলতেন, ‘তুমি একটা মস্ত বোকা’! সু চির প্রয়াত বাবা অং সান দেশটির আধুনিক সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা।
ফিরে দেখা
গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন সশস্ত্র বাহিনী প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইং। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন তিনি। এর ফলে দেশটির আইনি, নির্বাহী ও বিচারিক ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর হস্তগত হয়।
জ মিন তুন জানিয়েছেন, দেশটিতে জরুরি অবস্থা আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। তার কথায়, দায়িত্ব যদি শেষ না হয়, তবে সেটি (জরুরি অবস্থা) ছয় মাস বা প্রয়োজনে আরও বেশি বাড়ানো হবে।
তবে নতুন নির্বাচনের কোনও সময়সীমা জানাননি এ সেনা কর্মকর্তা। অবশ্য ২০০৮ সালের সামরিক সংবিধান অনুসারে দুই বছরের মধ্যে এ প্রক্রিয়া সম্পাদনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। জান্তা মুখপাত্রের কথায়, ‘আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, এটি বাস্তবে পরিণত করবোই।’
কিন্তু বহু পর্যবেক্ষকের প্রশ্ন রয়েছে, জান্তা সরকার কি আসলেই নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়, তাদের দেয়া নির্বাচন কি আসলেই সুষ্ঠু হবে, নির্বাচন হলেও তাতে সু চির দল এনএলডি অংশ নিতে পারবে তো?
জ মিন তুন জানান, ২০১১ সালে সামরিক বাহিনী শাসনভার ছেড়ে দেয়ার পর একটি আধা-বেসামরিক সরকার গঠিত হয়েছিল, এর ফলশ্রুতিতে ২০১৫ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে সু চি বিশাল ব্যবধানে জিতেছিলেন। এ সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যদি শুরু থেকেই তাকে না চাইতাম, তাহলে এ ধরনের কিছু ঘটত না।’
অবশ্য ২০০৮ সালের সংবিধান এমনভাবে তৈরি হয়েছিল যাতে গণতান্ত্রিক সরকার থাকা সত্ত্বেও সামরিক বাহিনীর হাতেও ক্ষমতা থাকবে। এর জন্য দেশটির সংসদে এক-চতুর্থাংশ আসন বরাদ্দ হয় সামরিক নেতাদের জন্য। ফলে যেকোনও ধরনের সাংবিধানিক সংস্কারের বিরুদ্ধে ভেটো দেয়ার ক্ষমতা পান জেনারেলরা। তাছাড়া ক্ষমতাধর তিনটি মন্ত্রণালয়ও (প্রতিরক্ষা, সীমান্ত ও স্বরাষ্ট্র) রাখা হয় সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
জান্তা সরকারের মুখপাত্র সিএনএন’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে সু চির বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগে মামলা চলার কথা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে ঘুষগ্রহণ, অবৈধভাব ওয়াকিটকি আমদানি, করোনাবিধি লঙ্ঘনের মতো অভিযোগও রয়েছে। তবে গণতন্ত্রপন্থী এ নেতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ দেশের গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘন। এর জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে তার।
গত নভেম্বরের নির্বাচনে প্রায় ৮৩ শতাংশ ভোটে জিতেছিল সু চির দল। এর ফলে সরকার গঠনের পর সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা হ্রাসের মতো সাংবিধানিক সংস্কারের ক্ষমতা পেয়ে যেত এনএলডি। কিন্তু শপথগ্রহণের কিছুদিন আগেই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেয় সামরিক বাহিনী।
অভ্যুত্থানের সপক্ষে সাফাই গেয়ে জান্তা সরকার শুরু থেকেই নভেম্বরের নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ করেছে। জ মিন তুনও দাবি করেছেন, তাদের কাছে এর শক্ত প্রমাণ রয়েছে। তবে তেমন কোনও প্রমাণ সিএনএন’কে দেখাননি তিনি।
রাজপথে রক্তপাত
সাক্ষাৎকার থেকে এটি স্পষ্ট যে, মিয়ানমার জান্তা বিশ্বকে বিশ্বাস করাতে চায়, তারা একটি ‘বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশ’ গড়ার লক্ষ্যে আইন ও সংবিধানের সীমারেখা মেনে কার্যক্রম চালাচ্ছে। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে বিক্ষোভকারীদের রক্তে ভেজা রাজপথ সেই দাবি মিথ্যা প্রমাণ করছে।
স্থানীয় পর্যবেক্ষক অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনারসের হিসাবে, মিয়ানমারে জান্তা-নিয়ন্ত্রিত নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৬০০ জনেরও বেশি সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের দূত সেখানে বেআইনি গুম, বন্দি ও কারাগারে নির্যাতন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনার বলেছেন, জান্তা সরকার বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে গ্রেনেড, মেশিনগান, স্নাইপার রাইফেলের মতো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে।
দেশটিতে তিন হাজারেরও বেশি মানুষকে আটক করা হয়েছে, যাদের অনেকের কোনও খোঁজ পাচ্ছে না পরিবার। আবার, রাতের বেলা অভিযান চালিয়ে হত্যা করা হতে পারে আশঙ্কায় পালিয়ে থাকতে হচ্ছে বহু বিক্ষোভকারী, সমাজকর্মী, সাংবাদিক ও ভুক্তভোগী পরিবারকে।
তবে এসব ঘটনার জন্য পুরো দোষটাই গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভকারী ওপর চাপিয়েছেন জান্তা মুখপাত্র। জ মিন তুনের দাবি, বিক্ষোভকারীরা সরকারি কর্মকর্তাদের কাজে যেতে বাধা দেয়ায় নিরাপত্তা বাহিনী চড়াও হতে বাধ্য হয়েছে।
যদিও বাস্তবতা ভিন্ন। মিয়ানমারে হাজার হাজার সরকারি কর্মকর্তা, চিকিৎসক, নার্স, আইনজীবী, শিক্ষক, প্রকৌশলী, কারখানার কর্মী চাকরি ছেড়ে জান্তাবিরোধী প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন। তাদের এই ধর্মঘটকে বলা হচ্ছে নাগরিক অবাধ্যতা আন্দোলন, যার লক্ষ্য সামরিক বাহিনীকে অর্থ সংকটে ফেলা।
জ মিন তুন বলেন, শুরুর দিকে বিক্ষোভকারীরা নিরাপত্তা বাহিনীর দিকে পাথর ও গুলতি নিক্ষেপ করত; কিন্তু এখন তারা বালুর বস্তা দিয়ে রাস্তা অবরোধ করছে, হাতে তৈরি বন্দুক দিয়ে গুলি করছে, আগুন ছুড়ে মারছে, মটোলভ (ককটেল) মারছে। একারণে নিরাপত্তা বাহিনী দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে অস্ত্র ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছে।
এসময় বিক্ষোভকারীদের গুলতিকে নিরাপত্তা বাহিনীর বন্দুকের মতো ভয়াবহ হিসেবে তুলনা করছেন কি না জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, নিরাপত্তা বাহিনী ‘ন্যূনতম শক্তি’ ব্যবহার করছে।
জান্তা মুখপাত্র বলেন, আমরা দাঙ্গা থামাতে নামলে মৃত্যু হতে পারে। তবে আমরা নিয়ম ছাড়া গুলি চালাচ্ছি না।
মিয়ানমারের সামরিক সরকারের হিসাবে, সাক্ষাৎকারটি চলার সময় বিক্ষোভকালে মৃতের সংখ্যা ছিল ২৪৮ জন, যার মধ্যে ১০ জন পুলিশ ও ছয়জন সেনা সদস্যও রয়েছেন। অথচ বেশিরভাগ মানবাধিকার সংস্থার হিসাবে মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে প্রাণহানির সংখ্যা এর দ্বিগুণেরও বেশি।
শিশুদের হত্যা
জাতিসংঘের হিসাবে মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের পর এপর্যন্ত অন্তত ৪৬ শিশু নিহত হয়েছে। বাড়ির মধ্যে বা বাইরে খেলার সময়ও শিশুদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে জানতে পেরেছে সিএনএন।
নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে শিশুদের মৃত্যুর বিষয়টি জানতে চাইলে জ মিন তুন দাবি করেন, বিক্ষোভকারীরা শিশুদের সামনের সারিতে ব্যবহার করায় এমন ঘটনা ঘটেছে।
তিনি বলেন, কিছু জায়গায় তারা শিশুদের সহিংস দাঙ্গায় যোগ দিতে উস্কানি দিচ্ছে… এর কারণে নিরাপত্তা বাহিনী চড়াও হলে তারা আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে।
জান্তা মুখপাত্রের কথায়, শিশুদের গুলি করার কোনও কারণ নেই। এটি শুধু ‘সন্ত্রাসীরা’ আমাদের খারাপ দেখানোর জন্য করছে।
ইয়াঙ্গুনে সিএনএন টিমের সঙ্গে কথা বলার পরপরই ১১ জনকে আটক করেছিল মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। পরে অবশ্য আটজনকে ছেড়ে দেয়া হয়। এ বিষয়েও জানতে চাওয়া হয়েছিল জ মিন তুনের কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর ভয় ছিল ওরা অন্যদের উস্কানি দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করতে পারে। এজন্যই তাদের আটক করা হয়।
সিএনএন জানতে পেরেছে, ছাড়া পাওয়া ওই আটজন এখন পালিয়ে রয়েছেন। তাদের আবারও আটক করার আশঙ্কা রয়েছে।