বিভিন্ন পণ্যে ছাড়ের ছড়াছড়ি দিয়ে আসা ‘ধামাকা শপিং ডট কম’ নামে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের আড়ালে লক্ষ্যই ছিল প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাৎ। কোনো ধরনের অনুমোদন ও লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা শুরু করার ৬ মাসের মধ্যেই তিন লাখ গ্রাহক তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি।
ধামাকা শপিং সর্বমোট ৭৫০ কোটি টাকার লেনদেন করলেও বর্তমানে অ্যাকাউন্টে রয়েছে এক লাখ টাকারও কম। প্রতিষ্ঠানটির কাছে বর্তমানে সেলারদের বকেয়া রয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা, ক্রেতাদের বকেয়া ১৫০ কোটি টাকা ও গ্রাহকদের রিফান্ড চেক বকেয়া রয়েছে প্রায় ৩০-৪০ কোটি টাকা।
বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) ভোরে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে ধামাকা শপিংয়ের চিফ অপারেশন অফিসার (সিওও) সিরাজুল ইসলাম রানাসহ (৩৪) তিন জনকে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশ ব্যাটালিয়ন (র্যাব-২)।
গ্রেফতার বাকি দুইজন হচ্ছেন- ধামাকা শপিংয়ের মোবাইল ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ক্যাটাগরি হেড ইমতিয়াজ হাসান সবুজ (৩১) ও ইলেক্ট্রনিক্স ক্যাটাগরি হেড ইব্রাহিম স্বপন (৩৩)।
বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, ২৩ সেপ্টেম্বর টঙ্গী পশ্চিম থানায় এক ভুক্তভোগীর দায়েরকৃত মামলা ও বেশকিছু ভুক্তভুগীর অভিযোগের ভিত্তিতে ধামাকা শপিংয়ের সিওওসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৮ সালে ‘ধামাকা ডিজিটাল’ যাত্রা শুরু করলেও ২০২০ সাল থেকে ‘ধামাকা শপিং ডট কম’ নামে কার্যক্রম শুরু করে। ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে প্রতিষ্ঠানটি নেতিবাচক অ্যাগ্রেসিভ স্ট্র্যাটিজি নিয়ে মাঠে নামে।
তিনি বলেন, ধামাকা শপিংয়ের কোনো প্রকার অনুমোদন ও লাইসেন্স নেই, ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্টও নেই। ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ব্যবসায়িক লেনদেন করা হয়েছে। গ্রাহকদের সঙ্গে এ পর্যন্ত প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। অথচ বর্তমানে অ্যাকাউন্টে এক লাখ টাকারও কম রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে বর্তমানে সেলারদের বকেয়া রয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা, ক্রেতাদের বকেয়া ১৫০ কোটি টাকা এবং ক্রেতাদের রিফান্ড চেক বকেয়া ৩৫-৪০ কোটি টাকা।
গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, আর্থিক সংকটের কারণে কয়েক মাস ধরে প্রতিষ্ঠানের অফিস এবং ডিপো ভাড়া বকেয়া রয়েছে। জুন থেকে কর্মচারীদের বেতনও বকেয়া। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ‘ধামাকা শপিং ডট কম’ অর্থ অন্যত্র সরিয়ে ফেলার কাজ শুরু করে, যার ফলে বর্তমানে ধামাকার প্রায় সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
মহাখালীতে তাদের প্রধান কার্যালয় এবং তেজগাঁও বটতলা মোড়ে একটি ডেলিভারি হাব রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৬০০টি ব্যবসায়িক চেইন রয়েছে, এরমধ্যে নামিদামি প্রতিষ্ঠানের নামও উঠে এসেছে।
ধামাকার পরিচালনা পর্ষদের ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড, মাইক্রোট্রেড ফুড এবং বেভারেজ লিমিটেড এবং মাইক্রোট্রেড আইসিক্স লিমিটেডসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গ্রাহক চেইন বা নেটওয়ার্ক থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই ছিল ধামাকার কৌশল। এছাড়া, ‘হোল্ড মানি প্রসেস প্লান’ অর্থ্যাৎ গ্রাহক ও সরবরাহকারীর টাকা আটকে রেখে অর্থ সরিয়ে ফেলা ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য।
তিনি বলেন, ধামাকার গ্রাহক সংখ্যা তিন লাখের বেশি। প্রতিষ্ঠানটি এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ২০ শতাংশ পণ্য সরবরাহ করে অর্থ সরিয়ে গ্রাহকদের চেক প্রদান করা হয়। বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার গ্রাহকের বকেয়া রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অক্টোবর থেকে তারা অ্যাগ্রেসিভ বিজনেসে যায়। ধামাকা খুব অল্প সময়েই প্রচুর টাকা সরিয়ে ফেলে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ১৪টি অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছে। সিআইডির তদন্তেও ১১৬ কোটি টাকা অস্বচ্ছতার বিষয়টি উঠে এসেছে। বাণিজ্য মন্তণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানোর পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কাজ শুরু করেছে। যাদের বিরুদ্ধেই মামলা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
অর্থ সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণ গ্রাহকরা যে টাকা দিয়েছে তা গেছে ইনভেরিয়েন্ট টেলিকমের অ্যাকাউন্টে। ধামাকার মালিকদের আরও অনেক ব্যবসা রয়েছে, সেসব ব্যবসায় সেই টাকা স্থানান্তর করা হতে পারে। এছাড়া, মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টি তদন্তে বেড়িয়ে আসবে। মূলহোতা জসিম উদ্দিন চিশতির নিজস্ব সম্পদ রয়েছে ২৫০ কোটি টাকার ওপরে, সেখানেও ধামাকার গ্রাহকদের টাকা যেতে পারে।
ধামাকার মূলহোতা জসিম উদ্দিন চিশতি কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি পলাতক, আমরা জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারদের মাধ্যমে জেনেছি তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন। আমরা তাকেসহ অন্যান্য আসামিদের খুঁজছি।