দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি আবারও নিয়ন্ত্রণের পথে। পাঁচ সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ নিম্নমুখী। ইতিমধ্যে সব ধরনের বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, পরিস্থিতি আপাতত স্বস্তিদায়ক হলেও শঙ্কামুক্ত থাকার সুযোগ নেই। যেকোনো সময় আবার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদদের এমন আশঙ্কার বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণেও দেখা যায়। এই মহামারিকালে আগেও দুই দফায় তিন থেকে চার মাস করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু করোনার নতুন ধরন ডেল্টা ও অমিক্রনের বিস্তারে বড় দুটি ঢেউ দেখা গেছে।
এই পরিস্থিতিতে আজ ৮ মার্চ দেশে করোনা সংক্রমণের দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম নতুন এই ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের সব দেশে। বাংলাদেশে প্রথম করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। গতকাল সোমবার পর্যন্ত দুই বছর দেশে মোট ১৯ লাখ ৪৭ হাজার ৭০২ জনের দেহে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে অনেকে একাধিকবার সংক্রমিত হয়েছেন। করোনায় সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৮৯ জনের। ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্য অনুযায়ী, মোট আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে এখন বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৪১তম। আর মৃত্যুর দিক থেকে অবস্থান ৩২তম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গতকাল এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সারা বিশ্বে মোট ৪৪ কোটি ৮ লাখের বেশি মানুষের দেহে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে ৭ কোটি ৮৪ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন প্রায় সাড়ে ৯ লাখ মানুষ। আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পর ভারতের অবস্থান। দেশটিতে ৪ কোটি ২৯ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে মোট শনাক্ত ও মৃত্যুর বেশির ভাগই হয়েছে সংক্রমণের দ্বিতীয় বছরে। মোট আক্রান্তের ৭২ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং মৃত্যুর ৭০ দশমিক ৬২ শতাংশ হয়েছে শেষ এক বছরে। এ সময়ে করোনার নতুন ধরন ডেলটা এবং এরপর অমিক্রন সংক্রমণের দুটি ঢেউ দেখা গিয়েছিল। ডেলটার পর অমিক্রনের সংক্রমণও এখন কমে এসেছে।
তবে সংক্রমণ যেকোনো সময় বাড়তে পারে—এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, অনেক মানুষ টিকার আওতায় এসেছে বলে ঝুঁকির মাত্রা তুলনামূলক কম হবে বলে ধারণা করা যায়। এখন সারা বিশ্বে সংক্রমণ পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো। কিন্তু আফ্রিকা অঞ্চলের অনেক দেশে টিকা দেওয়ার হার এখনো অনেক কম। যেকোনো সময় নতুন ধরন আসতে পারে। সাধারণত নতুন কোনো ধরন না এলে তিন মাসের মতো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর নতুন ধরন ছড়িয়ে পড়লে যেকোনো সময় সংক্রমণ বাড়তে পারে।
গত দুই বছরে সংক্রমণচিত্রে কয়েক দফা ওঠানামা দেখা গেছে। দেশে প্রথম সংক্রমণ পরিস্থিতি খারাপ আকার ধারণ করেছিল ২০২০ সালের মে–জুনে। মাঝে কিছুদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকার পর গত বছরের জুন–জুলাইয়ে দেখা দেয় করোনায় দ্বিতীয় ঢেউ। এরপর সাড়ে তিন মাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল। গত বছরের শেষ দিক থেকে অমিক্রনের বিস্তারে শুরু হয় সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ। চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ দিক থেকে সংক্রমণে আবার নিম্নমুখী প্রবণতা শুরু হয়।
পাঁচ সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ নিম্নমুখী। এর মধ্যে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৪৩৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ২ দশমিক ১৮ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারণ করা মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশে টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়।
দুই বছর ধরে চলা এই মহামারিতে এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে গত বছরের ২৮ জুলাই। আর একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু ২৬৪। গত বছরের ৫ ও ১০ আগস্ট ২৬৪ জন করে মারা যান।
সংক্রমণ মোকাবিলা
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গত দুই বছরে বিভিন্ন সময়ে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। মাঝে কিছুদিন খোলার পর আবারও বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় এখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। গত দুই বছরে কয়েক দফায় সরকারি–বেসরকারি অফিস আদালতও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
সংক্রমণ মোকাবিলায় গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশে করোনার টিকা দেওয়া শুরু হয়। শুরুতে টিকাদান কার্যক্রমে ধীরগতি থাকলেও ক্রমে টিকার আওতা ও পরিধি বাড়ানো হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত রোববার পর্যন্ত এক ডোজ টিকা পেয়েছেন সাড়ে ১২ কোটির বেশি মানুষ। সে হিসাবে দেশের মোট জনসংখ্যার ৭৩ শতাংশের বেশি মানুষ অন্তত এক ডোজ টিকা পেয়েছেন। দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন প্রায় পৌনে ৯ কোটি মানুষ।
জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি আপাতত স্বস্তিদায়ক। কিন্তু আপ্লুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এর আগেও কয়েক দফা এ রকম পরিস্থিতি দেখা গেছে। কোভিড-১৯ এখন মানুষের সঙ্গে বসবাস করছে। আর ভাইরাসের চরিত্র হলো প্রতিনিয়ত ধরন বদলানো। কখন সংক্রমণ বাড়তে পারে, তা পূর্বানুমান করা যায় না। তবে পুরো বিশ্ব থেকে ভাইরাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত হঠাৎ হঠাৎ সংক্রমণের ঢেউ দেখা দেবে। সুরক্ষার জন্য করোনার টিকা দিতে হবে। বাইরে গেলে নিয়মিত মাস্ক পরতে হবে।
পিএসএন/এমঅাই