পাবনা থেকে বাসে এসে ব্যবসায়ী রফিক মোল্লা ২৫ অক্টোবর ভোরে নামেন রাজধানীর উত্তরা জসীম উদ্দীন রোডে। মুহূর্তে কয়েক যুবক এসে ছুরি মেরে তাঁর মোবাইল ফোন, মানিব্যাগসহ সবকিছু কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। ২ অক্টোবর আত্মীয়কে বিদায় জানাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন সবজি বিক্রেতা মো. আলমগীর। রাত ১২টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে মাইক্রোবাসে আসা কয়েকজন নিজেদের পুলিশ পরিচয়ে মারধর করে তাঁর টাকা ছিনিয়ে নেয়।
উত্তরা এলাকায় প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটছে। সন্ধ্যা নামলেই বাসিন্দা ও পথচারীর মধ্যে জেঁকে বসছে ছিনতাই আতঙ্ক। সরেজমিন জানা যায়, উত্তরা হাউস বিল্ডিং, আবদুল্লাহপুর ব্রিজ ও বিমানবন্দর গোলচত্বর এলাকায় বেড়ে গেছে বহিরাগত ও মাদকাসক্তদের দৌরাত্ম্য। তারাই সংঘবদ্ধভাবে ছিনতাই করছে।
রফিক মোল্লা সমকালকে বলেন, ‘ব্যবসার কারণে প্রতি মাসেই ঢাকায় আসি। ২৫ অক্টোবর ভোরে ভয়ংকর ঘটনার ট্রমা এখনও কাটেনি।’ আরেক ভুক্তভোগী আলমগীরকে মাইক্রোবাসে তুলে সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘এখনও আমি মাইক্রোবাস দেখলে চমকে উঠি। রাস্তায় বের হলেই মনে হয়, পেছন থেকে কেউ তাড়া করছে। চিকিৎসক দেখিয়েছি, খুব একটা লাভ হয়নি।’
বুধ ও বৃহস্পতিবার উত্তরা, তুরাগ ও আশপাশের স্থানীয়রা একাধিক চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনার কথা জানান। তবে ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ না করায় প্রতিদিনের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। বিমানবন্দর গোলচত্বর থেকে আবদুল্লাহপুর ব্রিজ পর্যন্ত আতঙ্ক বেশি। দিনরাতে এখানে একাধিক টানা পার্টি ছুরি ও সুইচগিয়ার হাতে সক্রিয় থাকে। দিনে থাকে মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি ও পকেটমার।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে দেড় ঘণ্টা বিমানবন্দর থানায় কোনো অভিযোগ জমা পড়েনি। ডিউটি অফিসার কয়েকজন মিলে আলাপ করছেন। অন্য শাখার কর্মকর্তারাও অক্টোবরের অপরাধ প্রতিবেদন তৈরিতে ব্যস্ত। দুপুর সাড়ে ১২টার পর এসে হারানোর ঘটনায় জিডি করেন কাতারপ্রবাসী যাব্দুর আলী। পরে তিনি জানান, দুই বছর পর ২৬ অক্টোবর ভোরে দেশের মাটিতে নামেন। পৌনে ৮টার দিকে বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে ফুট ওভারব্রিজ পার হওয়ার সময় ম্যানিব্যাগ ও মোবাইল ফোন খোয়া যায় তাঁর। মানিব্যাগে গুরুত্বপূর্ণ নথি রয়েছে। এগুলো না পেলে কাতার ফিরে জটিলতা হবে।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে উত্তরা ৮ নম্বর সেক্টর মসজিদ মার্কেটের সামনে থেকে একটি মোটরসাইকেল চুরি হয়। মালিক জাহিদ হাসান মিন্টু উত্তরা পূর্ব থানায় অভিযোগ করেন। পরে রাতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের রোস্তমপুর থেকে সেটি উদ্ধার করে পুলিশ। চক্রের সদস্য জুবায়ের আহমেদকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। জাহিদ হাসান বলেন, ‘মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে আমার পাশ থেকে মোটরসাইকেল নাই হয়ে গেল। উত্তরার মতো জায়গায় এমন চুরি-ছিনতাই ভাবা যায় না।’
স্থানীয়রা বলছেন, উত্তরায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির তিন হটস্পট হলো– উত্তরা হাউস বিল্ডিং, আবদুল্লাহপুর ব্রিজ ও বিমানবন্দর গোলচত্বর এলাকা। জসীম উদ্দীন ও ৮ নম্বর সেক্টরের মুখেও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
পুলিশের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এসব স্পটে ছিনতাই ও ডাকাতির সঙ্গে জড়িতরা বহিরাগত। টঙ্গী, দক্ষিণখান, উত্তরখান ও তুরাগ এলাকা থেকে এসে টানা পার্টির কাজ করে। মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলে এসে সড়কের পাশে গাড়ির জন্য অপেক্ষারত পথচারীদের জিম্মি করে ২-৩ মিনিটেই সর্বস্ব নিয়ে পালিয়ে যায়।
শুধু অক্টোবরে ৬৭ ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে বিমানবন্দর থানা পুলিশ। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের সাত দিন থেকে এক বছর পর্যন্ত সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন। এর পরও থামছে না ছিনতাই।
পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, উত্তরার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে সংঘবদ্ধ ডাকাতিতে জড়িত একাধিক গ্রুপ তাদের নজরদারিতে রয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন ইডেন কলেজের এক অধ্যাপকের বাসা ও আবাসিক হোটেলে ডাকাতি করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছে।
ডিএমপির উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার আহমেদ আলী বলেন, উত্তরায় তিন স্পটে ছিনতাই বেশি হচ্ছে। ভোর কিংবা রাতে বাইরে থেকে যাত্রীরা নামলে, মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসে এসে ছোঁ মেরে জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। জড়িতদের বেশির ভাগই উত্তরার আশপাশের বাসিন্দা। এসব স্পটে পুলিশকে সতর্ক রাখা হয়েছে।