প্রায় ছয় বছর ধরে সংসার করছেন একটি বেসরকারি টেলিকম প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মুসফিকুর রহমান ও সামিনা আক্তার দম্পতি। ছয় বছরে সংসারে যুক্ত হয়েছে তাদের একমাত্র শিশুপুত্র। স্ত্রী সামিনা গৃহিণী। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছর দুয়েক আগে এমবিএ শেষ করেছেন। শুরুতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও এখন সন্তানের দেখাশোনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
চাকরির পাশাপাশি ঘরের কাজে নিজের স্ত্রীকে নিয়মিত সহযোগিতা করেন স্বামী মুসফিকুর। তার মতে, ঘরের কাজ স্বামী ও স্ত্রী দুজনেরই সমানভাবে ভাগাভাগি করে নেয়া উচিত।
রাজধানীর চামেলিবাগ এলাকার বাসিন্দা মুসফিক বলেন, ‘আমরা সংসারের শুরু থেকেই পরস্পরকে সহযোগিতা করে আসছি। হয়তো আমার স্ত্রী রান্না করছে আর খাওয়ার পর থালাবাসনগুলো আমি মেজে রাখছি। স্ত্রী ছেলেকে স্কুলে আনা-নেয়া করলে আমি হয়তো সন্ধ্যায় তার পড়া দেখিয়ে দিচ্ছি।’
মুসফিকের স্ত্রী সামিনা চাকরি না করার কারণ হিসেবে বলেন, ‘মূলত সন্তানের দেখাশোনার জন্যই আমরা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ঢাকার বাইরে থাকেন। যদি চাকরি করতে হয়, সে ক্ষেত্রে সন্তানকে অন্য কারও দায়িত্বে ছেড়ে দিতে হবে। মূলত এ কারণেই আপাতত চাকরি করছি না।’
বিষয়টিকে আরেকটু ব্যাখ্যা করে মুসফিক বলেন, ‘আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি ধারণা হচ্ছে হাউস ওয়াইফের কাজ কোনো কাজের পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু আমরা এটা মনে করি না।
‘কারণ আমার স্ত্রী আমাদের সংসারটাকে গুছিয়ে রাখছেন, আমাদের সন্তানকে গড়ে তোলার দায়িত্বও নিয়েছেন, আমি মনে করি এটি অনেক বড় একটি দায়িত্ব। যদি আমার স্ত্রী এই দায়িত্ব পালন না করতেন তাহলে আমাকে এই দায়িত্বটি নিতে হতো। আমরা সংসারের শুরুতেই এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। আমার স্ত্রী এই স্যাক্রিফাইসটি করতে রাজি হয়েছেন।’
নতুন প্রজন্মের উচ্চশিক্ষিত দম্পতিদের মধ্যে সম্প্রতি এ ধরনের একটি প্রবণতা বিদ্যমান। ঘরের কাজ নারীর– সমাজের প্রচলিত এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসছে তরুণ-তরুণীরা। অনেক ক্ষেত্রে ঘরের কাজকে নিজের কাজ মনে করে তাতে সংবেদনশীল আচরণ করছেন নারীর পুরুষ সঙ্গীটিও।
এ রকম আরেকটি দম্পতি রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা আসাদ উল্লাহ ও নুসরাত জাহান। দুজনই চাকরি করছেন দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। কাজ শেষে ঘরে ফিরে ঘরের কাজগুলো করছেন ভাগাভাগি করেন।
নুসরাত বলেন, ‘সংসার যেহেতু দুজনের, কাজগুলোও ভাগাভাগি করে ফেললে সময় কম লাগে, আর নিজেদের মধ্যে সম্পর্কটাও মজবুত থাকে। সংসারে যখন স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও দায়িত্বশীল হলে অনেক সমস্যাই সমাধান হয়ে যায়।’
শহুরে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হিসেবে নারীর শিক্ষার বিস্তৃতি ও নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য বৈষম্য কমাতে অনেক পথ বাকি বলেও মন্তব্য তাদের।
নারীদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা উই ক্যান-এর প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক বলেন, ‘একজন পুরুষ তার নারী সহকর্মীটির প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করলেও অনেকাংশে ঘরে স্ত্রীর প্রতি সেই আচরণটি করেন না। ঘরের কাজ শেয়ার করে করার মানসিকতা এখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি। এ ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন এলেও সমতার যে সম্পর্ক সেটি তৈরি হতে হয়তো আরও একটি প্রজন্ম লাগবে।
‘যে নারীটি গার্মেন্টসে কাজ করছেন, তাকে হয়তো খুব ভোরে ঘর থেকে বের হতে হয়। তার যে পুরুষ সঙ্গীটি আছেন, তিনি দেখা যায় তার জন্য খাবার রাঁধছেন। এটা তিনি করছেন সংসারের প্রয়োজনে। কিন্তু এর বিপরীত চিত্র দেখা যাবে গ্রামীণ সমাজে। যেমন কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও সেটির স্বীকৃতি এখনও মেলেনি। এটাকে ঘরের কাজ হিসেবেই মনে করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘আবার যদি পুরুষ সঙ্গীটি সংবেদনশীলও হন, তিনি সামাজিক উপহাসের ভয়ে সেটি প্রকাশ করতে পারেন না। এ সমাজে বিষয়টি এখনও পরিবর্তন হয়নি।
‘তবে অর্থনৈতিকভাবে নারী যখন ক্ষমতায়িত হচ্ছেন, তখন তার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও আসছে। এরপরও যে তিনি স্বামী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা নির্যাতিত হচ্ছেন না, এটা বলা যাবে না। মূল কথা হলো, পুরুষকে নারীর প্রতি আরও সংবেদনশীল হতে হবে। তাহলেই এ অবস্থার পরিবর্তন আসবে।’
পিএসএন/এমঅাই