দেশের বিভিন্ন সড়কে বাস, সিএনজি, ব্যাটারি বা অটো রিকশার নৈরাজ্য এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। এসব নিরসনে আগের সরকার বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা দেখায়নি।
ঠিক একই অবস্থা খুলানাতেও। নগরীর ব্যস্ততম গল্লামারীর মোড়ে প্রতিদিনই যানজট লেগেই থাকে। গল্লামারী সেতুর দুই পাড়ের দীর্ঘ যানজটের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী মানুষ সঠিক সময় গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না। মাঝেমধ্যে যানজটের ভয়াবহতা এতটাই তীব্র থাকে, পাঁচ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতে ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। এর মুখ্য কারণ ইজিবাইকের নৈরাজ্য। এসব নিরসনের উদ্যোগ নিতে বলার পর ট্রাফিক বিভাগ কাজ করছে। কিন্তু দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা মিলছে না।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) ইংরেজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক মো. সামিউল হক গল্লামারী এলাকার তীব্র যানজটের বর্ণনা দিতে গিয়ে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, লাইসেন্সের বাইরে কয়েক গুণ বেশি ইজিবাইক অবৈধভাবে চলছে। এতে যানজট অসহনীয় হয়ে উঠছে। প্রতিনিয়ত শহরে ইজিবাইক বৃদ্ধির কারণে যাতায়াতে ভোগান্তি বাড়ছে নগরবাসীর। স্বল্প দূরত্বের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে সীমাহীন দুর্ভোগ ও সময়ের অপচয় হচ্ছে।
ময়লাপোতার মোড়ের বাসিন্দা মো. আজমীর বলেন, মোড়ে সারাদিনই যানজট লেগে থাকে। সড়কে কোনো শৃঙ্খলা নেই। অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান না হওয়া, বিশেষ করে ইজিবাইকগুলোর অবাধ চলাচল শহরে অসহনীয় যানজট সৃষ্টি করছে। আশপাশের উপজেলার ইজিবাইক শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সকাল থেকে রাত। প্রয়োজনের অধিক এসব ইজিবাইকের কারণে যানজট কমছে না।
খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) সূত্রে জানা গেছে, মহানগরে ৮ হাজার ইজিবাইক, ২ হাজার ৯৮টি মালবাহী ইজিবাইক ও ১৭ হাজার রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, নগরীতে বৈধ ইজিবাইকের সংখ্যা ৮ হাজার হলেও সড়কে চলছে এর দ্বিগুণ। মাসোয়ারা, ভুয়া ব্লু-বুক ও স্টিকার ব্যবহারসহ নানা উপায়ে চলছে অবৈধ এসব ইজিবাইক। ফলে মোড়ে মোড়ে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ঘটছে দুর্ঘটনা। চরম ভোগান্তিতে পড়ছে মানুষ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর গল্লামারী মোড়, ময়লাপোতা মোড়, ডাকবাংলোর মোড়, পিকচার প্যালেস মোড়, সদর থানার মোড়, শিববাড়ির মোড়, সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল, নিউ মার্কেটের সামনে, শান্তিধাম মোড়, পিটিআই মোড়ে প্রতিনিয়ত দীর্ঘ যানজট লেগে থাকে। রাস্তা পারাপারেও ভোগান্তির অন্ত নেই। যাত্রী ওঠানামা করতে রাস্তার সব জায়গায় দাঁড়াচ্ছে ইজিবাইক চালকরা। ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।
ট্রাফিককে তো তারা পাত্তা দেয়ই না। কাউকে আইন মানতে বললে তারা বাজে শব্দ ব্যবহার করে। দিনের পর দিন আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে ট্রাফিক সদস্যদের নাকে নিচ দিয়ে দেদারসে চলছে ইজিবাইকগুলো। সড়কের মোড়গুলোয় এলোমেলোভাবে এসব বাহন রেখে দেওয়া হয়। ফলে অন্য যানবাহন এমনকি পথচারীদের চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু ট্রাফিক সদস্যরা নির্ভার।
স্থানীয় কয়েকজন বলেন, উৎখাত হওয়া সরকারের আমলে বাস, সিএনজি, ইসিবাইক, ব্যাটারি চালিত রিকশাওয়ালা যা ইচ্ছা, তাই করতো। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর তাদের সাহস আরও বেড়ে গেছে। আইন তো মানেই না, সরকারের কথা বললেও পাত্তা দেয় না। তাদের ভাষ্য, ‘আগের সরকার পারে নাই, এই সরকার কি করবো?’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইজিবাইক চালক জানান, অধিকাংশ চালকই নিয়ম মানে না। যারা মানতে চাই তাদের নানা রকম কথা শুনতে হয়। মানুষও নানা কথা শোনায়। ট্রাফিক সদস্যরাও কিছু করে না। শহরের বাইরে থেকে ইজিবাইক নগরীতে ঢুকে চলাচল করায় সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) খুলনা মহানগর শাখার উপদেষ্টা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, কেসিসির অনুমোদনের বাইরে সড়কে অনেক বেশি ইজিবাইক চলছে। এসব গাড়ির বেশির ভাগ চালক ট্রাফিক আইন না জানায় নগরীর বিভিন্ন সড়কে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা।
তিনি আরও বলেন, সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সব যানবাহনকেই নিয়ম মেনে চলতে হবে। যে নিয়মগুলো ট্রাফিক বিভাগ, সিটি কর্পোরেশন অন্যান্য সংস্থা, যেমন- নিরাপদ সড়ক চাই সম্মিলিতভাবে দিকনির্দেশনা তৈরি করবে। ভ্যান, রিক্সা, ইজিবাইক গুলো একটি লাইনে চলবে এবং দিন ও রাতে দুটি শিফট করে চলবে; দ্রুতগামী যানবাহনের জন্য আলাদা লেন থাকবে যেগুলোয় রিকশা ভ্যান ইজিবাইক চলবে না; এছাড়া আরও অন্য কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে। ইজিবাইক ও ভ্যানের ক্ষেত্রে দুইটি কালার করে দিয়ে নির্ধারণ করে দিতে হবে; দিনের এক ভাগ সাদা কালার, দিনের দ্বিতীয় ভাগে কালো কালার। এতে সড়কে যানবাহনের সংখ্যায়ও কমে যাবে-যানজটও কমে যাবে। রাস্তার ডান পাশের লেন দ্রুতগামী বাহনের জন্য, বাঁ পাশটা ভ্যান রিক্সা ঠেলা গাড়ি ইজিবাইকের জন্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। এছাড়া আরও অনেক কৌশল আছে যা আলোচনায় বসলে বের হবে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) শাহরিয়ার মোহাম্মদ মিয়াজী বলেন, যানজট সমস্যার দ্রুত ও কার্যকর সমাধান করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ। ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে আলাপ করেছি। অবৈধ ইজিবাইক ইঞ্জিন চালিত রিকশা বন্ধের জন্য প্রথমে মাইকিং করা হবে। পরবর্তীতে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিছু যে করা হচ্ছে না, সেটা সঠিক না।
তিনি আরও বলেন, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে মামলা করছে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। মহানগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অভিযান পরিচালনা করে এসব মামলা দায়ের এবং জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। ৬ অক্টোবরের পর শহরে লাইসেন্স ছাড়া বাইরের কোনো গাড়ি ভিতরে প্রবেশ করবে না। সে বিষয়ে কার্যকারী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আশা করি দ্রুতই নগরবাসী একটা পরিবর্তন দেখতে পাবেন।