রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলার রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণ দেওয়া বিচারক কামরুন্নাহারের বিচারিক (ফৌজদারি) ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
ধর্ষণের ঘটনায় এক মামলায় স্থগিতাদেশ থাকার পরও আসামিকে জামিন দেওয়ার বিষয়ে তার ক্ষমতা সিজ করা হলো বলে সোমবার (২২ নভেম্বর) রায় দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ।
এর আগে সোমবার (২২ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে বিচারক কামরুন্নাহার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এজলাসকক্ষে প্রবেশ করেন।
পরে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের বেঞ্চে শুনানি হয়। কিন্তু সেখানে কী বিষয়ে শুনানি হয়েছে সেটি নিশ্চিত করেননি কেউ। কারণ উপস্থিত হওয়ার পরে বিচারক কামরুন্নাহারকে নিয়ে আপিল বিভাগে ক্যামেরা ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর পরে আপিল বিভাগের মূল দরজা দিয়ে বের হননি বিচারক।
জানা গেছে, এক মামলায় স্থগিতাদেশ থাকার পরও ধর্ষণের ঘটনায় আসামিকে জামিন দেওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে তলব করা হয়েছিল তাকে।
যে মামলায় তলব করা হয়েছিল, ওই মামলায় তার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে আদেশ দেওয়া হয়েছে গত ১৫ নভেম্বর। তবে সর্বোচ্চ আদালত কী আদেশ দিয়েছেন সেটিও জানা যায়নি।
জামিন নিয়ে কামরুন্নাহারকে যে মামলায় তলব করা হয়েছিল, সেই আবেদনটি ‘রাষ্ট্র বনাম আসলাম সিকদার’ হিসেবে আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ১ নম্বর ক্রমিকে ছিল গত ১৫ নভেম্বর। সেটি আজও ‘রাষ্ট্র বনাম আসলাম সিকদার’ হিসেবে কার্যতালিকার (ক্রিমিনাল পিটিশন-১০৮৮/২০১৯) শীর্ষে ছিল।
এ বিষয়ে গত ১৫ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ভার্চুয়াল বেঞ্চ আদেশ দিয়েছিলেন। আদালতে এদিন রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ।
এ বিষয়ে ১৫ নভেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আপিল বিভাগ বলেছেন, আদেশ দেওয়া হলো। তবে কী আদেশ দেওয়া হয়েছে, তা আদেশের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেলে জানা যাবে। বিচারক আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন কি না, তাও আদেশ পেলে বোঝা যাবে।
তলব ও মামলার বিবরণ থেকে জানা গেছে, আপিল বিভাগের স্থগিতাদেশ থাকার পরও ধর্ষণ মামলার এক আসামিকে জামিন দেওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গত বছরের ১২ মার্চ তলব করেছিলেন আপিল আদালত। ওই বছরের ২ এপ্রিল কামরুন্নাহারকে আদালতে হাজির হতে বলেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তাকে আদালতে হাজির হতে বলা হলেও তখন করোনার (কোভিড-১৯) কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা আর জানা যায়নি। আজ ওই মামলার বিষয়টি কার্যতালিকায় শুনানির জন্য আসে।
২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হাতিরঝিল থানায় একটি বেসরকারি টিভির উপস্থাপক আসলাম সিকদারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। ওই মামলায় ২০১৯ সালের ১৮ জুন হাইকোর্ট তাকে জামিন দেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ২৫ জুন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত জামিন স্থগিত করেন।
এদিন জামিন স্থগিত করে বিষয়টি আপিল বিভাগের নিয়মিত ও পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। আবেদনটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন থাকা এবং আপিল বিভাগের চেম্বার জজের স্থগিতাদেশ থাকার পরও গত বছরের ২ মার্চ ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক কামরুন্নাহার তাকে জামিন দেন।
সর্বোচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের পরও আসামিকে জামিন দেওয়ার বিষয়টি আপিল বিভাগের নজরে আনেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম। তিনি ওই সময় আদালতকে বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিতাদেশ থাকার পরও আসামিকে নিম্ন আদালতের জামিন দেওয়াটা আদালত অবমাননার শামিল। এভাবে জামিন দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১২ মার্চ আপিল বিভাগ সংশ্লিষ্ট বিচারককে ব্যাখ্যা জানাতে আদালতে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেন। সেইসঙ্গে আসলাম সিকদারকে দুই সপ্তাহের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন।
২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ধর্ষণের অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আসলাম সিকদারের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় ওই মামলা করা হয়। মামলায় গত বছরের ১৪ অক্টোবর রায় দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ এর বিচারক। রায়ে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আসলাম সিকদারকে খালাস দেওয়া হয়।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ সাংবাদিকদের জানান, ওই রায়ে খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্ট বিভাগে আপিল আবেদন করেছে। হাইকোর্ট আপিল শুনানির জন্য গ্রহণও করেছেন।
রেইনট্রি রায় নিয়ে আলোচনা ও বিচারিক দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার
মোছা. কামরুন্নাহার ছিলেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক। তিনি রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় ১১ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন। রায়ে পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেওয়া হয়। তবে ধর্ষণের ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে পুলিশকে মামলা না নেওয়ার পর্যবেক্ষণ দেওয়া বিচারক কামরুন্নাহারের ফৌজদারি বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রত্যাহারের আদেশ পেয়ে তিনি গত ১৪ নভেম্বর এজলাসে বসেননি।
এমন পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন আসে আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও জনসাধারণের পক্ষ থেকেও। এরপর গত শনিবার (১৩ নভেম্বর) আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান বিচারপতির কাছে বিচারক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন নিয়ে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সে জন্য একটা চিঠি লিখবেন।
এরপর গত ১৪ নভেম্বর সকালে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ওই বিচারককে আদালতে বসতে নিষেধ করেন। একই সঙ্গে কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে বর্তমান কর্মস্থল থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। এছাড়া তাকে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়।
পরে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) কামরুন্নাহারকে বর্তমান কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করা হয়।