‘এক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার ৭ সন্তানের কোটায় ৫ জনের চাকরি’ ১৩ জুলাই দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সংবাদ।
খালিচোখে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হওয়াই শ্রেয়। আসলেই কী তাই? সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫৪ বছর হতে পার হতে চললো। ৫৪ বছর মোটেও কম সময় নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অকুতোভয় বীর যোদ্ধাদের অবদান কোনোকিছুর বিনিময়েই শোধযোগ্য নয়। তবে কোটা প্রথার মাধ্যমে তাদের সেই অবদানকে বর্তমানে কিছুটা হলেও মানুষের কাছে নিচু করছে বিভিন্ন সেক্টরে কোটা প্রথা। যেখানে স্বয়ং মুক্তিযোদ্ধারাই চায় না কোটা থাকুক সেখানে সরকার কোন মন্ত্রবলে উজ্জিবিত হয়ে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও আপামর জনসাধারণের কথা মেধাবীদের কথা ভাবতে পারছে না, তা সত্যিই বোধগম্য নয়।
বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের কোটা সুবিধা কিছুতেই মানতে পারছে না বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। কোটা একেবারে বাতিল না হোক, অন্তত পক্ষে কোটার যৌক্তিক সংস্কার তো অবশ্যই করা যায়। কিন্তু ১৪ জুলাই হাইকোর্টের রায়ে পরিষ্কার হলো, কোটা পুনর্বহালই থাকছে।
মন্দার এই বাজারে সরকারি চাকরি যেন আস্ত সোনার হরিণ। তারপরেও একটা বয়স পর্যন্ত হাল ছাড়েন না তরুণ-তরুণীরা। দিনরাত লেগে থেকে চালিয়ে যান চাকরির পড়া। ধাপে ধাপে দেওয়া পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও মোক্ষম জায়গায় বাধার পাহাড়ে ঠেকে যায় অনেক মেধাবী প্রার্থীর চাকরি পাওয়া। কোটা, প্রশ্ন ফাঁসের মতো দুর্নীতি এবং সবশেষে রাজনৈতিক বিবেচনা- সাধারণ শিক্ষার্থীরা আসলে যাবে কোথায়? তারা তো এ দেশেরই নাগরিক। কোটা সুবিধা না থাকায় তারা নিজেদের কেনো তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করবে?
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা চলে আসছে সেই স্বাধীনতার পর থেকেই। কোটা কখনো কমেছে তো কখনো বেড়েছে। ২০১৮ সালে এই কোটাবিরোধী আন্দোলনে সরকার বাধ্য হয়ে দেশের ১ম ও ২য় শ্রেণির চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিল করে। ২০১৮ সালে কোটা বিলুপ্তির ঘোষণার আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৫৬% কোটা সংরক্ষিত ছিল। সর্বশেষ ২০২০ সালে ৩৮তম বিসিএসের মাধ্যমে শেষ হয় কোটার যুগ। কিন্তু এখন জানা গেলো বিসিএসের প্রশ্নই ফাঁস হচ্ছে হারহামেশাই।
সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের বঞ্চিত হওয়ার অন্যতম আরেকটি কারণ প্রশ্নপত্র ফাঁস। পিএসসির নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। এর আগেও কয়েকবার (পিএসসির) প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে পরীক্ষাও বাতিল করা হয়। সর্বশেষ ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ রেলওয়ের ‘উপসহকারী প্রকৌশলী’ পদসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে গত রোববার পিএসসির দুই উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ ১৭ জনকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
পিএসসি থেকে বলা হলো, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে গত কয়েকটি বিসিএসের পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২৪তম বিসিএস, ২৭তম বিসিএস। আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ৩৩তম লিখিত পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করা হয়।
পিএসসির চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘যে প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়, সেখানে ফাঁস করার সুযোগ খুব কম। তারপরও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। যদি কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কিন্তু সর্বোপরি কোটা কিংবা প্রশ্নফাস সবকিছুর আগে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন সেই দূর্নীতি। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এটিই দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান যার উপর ছাত্র-শিক্ষক অভিভাবকসহ জনসাধারণের একটা ভরসা ও আস্থা য়াছে। সরকারি উচ্চপদে প্রবেশ করার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করে পিএসসি। এটিই হলো চাকরিপ্রার্থীদের একমাত্র আশার প্রদীপ। কিন্তু এই প্রদীপের নিচে যে অন্ধকার, সেই অন্ধকারেই যদি প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে তাহলে ‘বেকার’ শ্রেণি কার কাছে যাবে কি করবে? মেধাবী চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনে ব্যস্ত রেখে অমেধাবী, অদক্ষ ও অযোগ্যদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ করে দিলে দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, দুর্নীতির যে চিত্র আজ আমরা দেখছি তা ছড়িয়ে পড়বে প্রতিটি সেক্টরে।
কোটা পদ্ধতি ও প্রশ্নফাঁসের সন্দেহ নিয়ে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম যেনো দ্বিধায় না ভোগে তা নিশ্চয়ই কারও কাম্য নয়। তাই সবার আগে দূর্নীতি রুখতে হবে। আর তা না পারলে একের পর এক ইস্যু গজিয়ে যাবে দিন কয়েক পর পর অথচ আড়ালেই থেকে যাবে মেধাবীদের অধিকার।
যেকোনো ধরনের প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতেই হবে। দেশের তরুণ প্রজন্মকে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধের কোনোই বিকল্প নেই। আর সেই দায় এবং দায়িত্ব অবশ্যই রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হতে হবে সবাইকে। এ অরাজকতা বন্ধ হতেই হবে। এসব দেখার জন্য প্রশাসনে যারা আছেন অতি অবশ্যই তাদের বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত।
-সাকিবুর রহমান, সংবাদকর্মী ও শিক্ষার্থী