আসন্ন বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভেতরে বিরাজমান বিভক্তি এখন অনেকটাই প্রকাশ্যে চলে এসেছে। দলের মধ্যকার বিভক্তি রূপ নিয়েছে সংঘাতে, যা এখন থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে।
সিটি নির্বাচনে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে বরিশাল আওয়ামী লীগে ক্রমেই বাড়ছে বিভক্তি আর অসন্তোষ। দলীয় মনোনয়ন পাওয়া খোকন এবং মনোনয়নবঞ্চিত বর্তমান মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ একে অপরের বিরুদ্ধে কিছু না বললেও সংঘাত-সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন তাদের অনুসারীরা।
এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার (১৫ মে) রাতে বর্তমান মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর একনিষ্ঠ কর্মী সদ্য বিলুপ্ত মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রইচ আহমেদ মান্না আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতের তিন কর্মীকে মারধর ও পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যার হুমকি দেন। এ ঘটনায় মামলা হলে ওই রাতেই ১২ সহযোগীসহ গ্ৰেফতার হন মান্না। এর ঠিক আটদিন আগে চলতি মাসের ৭ মে সন্ধ্যায় একই ঘটনা ঘটান মান্না। তখনও আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী খোকনের এক কর্মীকে মারধর ও পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যার হুমকি দেন তিনি। ওই ঘটনায়ও মান্নাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী।
পরদিন সকালে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মান্নাকে নির্দোষ দাবি করে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখানে লিখিত বক্তব্যে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট এ কে এম জাহাঙ্গীর বলেন, পুলিশ মূল ঘটনা আড়াল করে রইচ আহাম্মেদ মান্নাকে গ্রেফতারের ভিন্ন কারণ দেখিয়েছে। কিন্তু ঘটনাস্থল তো দূরের কথা, ঘটনাস্থলের দুই কিলোমিটারের মধ্যেও মান্না ছিল না।
মান্নার গ্ৰেফতারের বিষয়টি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করার দাবি জানায় মহানগর আওয়ামী।
এদিকে, খোকন সেরনিয়াবাত মনোনয়ন পাওয়ার একমাস পেরিয়ে গেলেও এখনো তার পক্ষে মাঠে নামেননি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ও তার অনুসারীরা। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার আগে থেকেই ঢাকায় অবস্থান করছেন সাদিক আবদুল্লাহ।
মেয়র পদে নৌকার মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর গত ১৮ এপ্রিল ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বরিশালের বাসভবন কালীবাড়ি রোডের সেরনিয়াবাত ভবনে তার সমর্থিত মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সভা করেন সাদিক আবদুল্লাহ। সেখানে তিনি মনোনয়ন পাওয়া আপন চাচা খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
ওই সভায় সভায় সাদিক আব্দুল্লাহ তার নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আমার চাচাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। অতএব এমন কেউ কোনো কাজ করবেন না যাতে আমাদের বদনাম হয় বা তৃতীয় পক্ষ ফায়দা লুটতে পারে। অনেক লোক লাফালাফি করে-করবে, ওটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবেন না। মনে রাখতে হবে যিনি নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি আমার আপন চাচা। কেউ মনঃক্ষুণ্ন হবেন না। রাজনীতি একদিনের নয়।
তিনি বলেন, নমিনেশন পাইছে আমার চাচা, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সন্তান। এখানে কাউকে সুযোগ দেওয়া যাবে না। শান্ত বরিশালকে শান্ত রাখতে হবে। অশান্ত করার কোনো সুযোগ নেই। সবাইকে একতাবদ্ধ থাকতে হবে। নৌকাকে জয় লাভ করাতে হবে। এখানে আমার চাচাকে নির্বাচিত করতে যা যা করা দরকার তাই করবো। সবাইকে মাথায় রাখতে হবে সামনে সংসদ নির্বাচন। নেত্রীর জন্য রাজনীতি করি, নেত্রী যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সেই সিদ্ধান্ত আমরা মাথা পেতে নিয়েছি। এখানে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। এ নির্বাচনে আমরা সঙ্গে থাকবো। এর বাইরে কোনো রাস্তা নেই।
এমন বক্তব্যের একমাস পেরিয়ে গেলেও এখনো বরিশালে গিয়ে চাচার পক্ষে মাঠে নামেননি সাদিক আবদুল্লাহ। এমনকি তার অনুসারীরাও খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে মাঠে নামছেন না।
এদিকে, মনোনয়ন পাওয়ার পর সাদিক আবদুল্লাহর বাবা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর সঙ্গে দেখা করে দোয়া নিয়েছিলেন খোকন সেরনিয়াবাত। এরপর খোকনের পক্ষে নির্বাচনী কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে হাসানাত আব্দুল্লাহর বরিশালে যাওয়ার কথা থাকলেও তিনি যাননি।
এরপর থেকে ক্রমশ খোকন এবং সাদিক অনুসারীদের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট হতে থাকে। সবশেষ তাদের বিভক্তি স্পষ্ট দেখা যায়, খোকন সেরনিয়াবাত ঘোষিত ১৬ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে। সেখানে সাদিক অনুসারী একজনকেও রাখা হয়নি। নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে কেবল সাদিকবিরোধীরাই ঠাঁই পেয়েছেন। নৌকার পক্ষে তারা প্রচার-প্রচারণাও চালাচ্ছেন।
সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারীদের অভিযোগ, নির্বাচনী কোনো কর্মকাণ্ডে তাদের রাখা বা ডাকা হচ্ছে না। তবে খোকন সেরনিয়াবাত বলছেন, আমি সবাইকেই নৌকার পক্ষে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছি। এরপরও কেউ না এলে, তাদের তো আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে আনতে পারব না।
গত ৩০ এপ্রিল ঘোষণা করা হয় খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচন পরিচালনার উপদেষ্টা কমিটি। সেখানে রাখা হয়নি মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে। তবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে।
মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও খোকনের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর দফায় দফায় হামলা করা হয়েছে। সবশেষ সোমবার রাতে তিনজনকে মেরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। যে ঘটনায় মামলাও হয়েছে। পুলিশ যেখানে মামলার তদন্ত করে সে বিষয়ে ওনারা সংবাদ সম্মেলন করে কীভাবে তা আমরা বুঝতে পারছি না। ওনারা কী এজেন্ডা দিতে চায়, কী বার্তা দিতে চায় সেটা তাদের প্রশ্ন করুন।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী নৌকার প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছেন। প্রার্থী দেওয়ার পর তারা নৌকার পক্ষে কাজ করবেন এটাই বাস্তবতা। কিন্তু যারা নৌকার কর্মীদের পিস্তল ঠেকিয়ে মারধর করে আহত করলো তাদের পক্ষে এভাবে সাফাই গেয়ে সংবাদ সম্মেলন কেন করে বুঝতে পারছি না। আর সাফাই গেয়ে নৌকার পক্ষে না বিপক্ষে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায় সেটা দেখার জন্য হাইকমান্ড রয়েছে এবং বরিশালের জনগণও আছে।