আইপিএলের মেগা নিলাম মানেই টানটান উত্তেজনা। প্রতিবারের মতো এবারও আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে একটি প্রশ্ন- কে হবেন সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়? গতবার কলকাতা নাইট রাইডার্স মিচেল স্টার্কের জন্য খরচ করেছিল রেকর্ড ২৪.৭৫ কোটি রুপি, যা টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল চুক্তি। এবার এই রেকর্ড ভাঙার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। তাছাড়া সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে হেনরিখ ক্লাসেনকে ধরে রাখতে ২৩ কোটি রুপির চুক্তির চেয়েও বড় দর হাঁকাতে পারে ফ্রাঞ্চাইজিগুলো। সৌদি আরবের জেদ্দায় ২৪ ও ২৫ নভেম্বর এবারের আইপিএলের মেগা নিলাম।
বেশির ভাগ ফ্র্যাঞ্চাইজিই তাদের তারকা আর কার্যকরী খেলোয়াড়দের ধরে রেখেছে। আবার কোনো কোনো দল অনেক নামী ও দামি খেলোয়াড়দের ছেড়ে দিয়েছে। এবার তাই জমজমাট লড়াই হবে মেগা নিলামে।
ঋশভ পন্ত: শেষ দিনে দিল্লি ক্যাপিটালসের সঙ্গে আলোচনায় সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হন পন্ত। ফলে এই অভিজ্ঞ উইকেটকিপার-ব্যাটার নিলামের পথে হাঁটেন। ভক্ত ও বিশ্লেষকদের ধারণা, এবারের আইপিএল নিলামে তিনি হতে পারেন অন্যতম দামি খেলোয়াড়। এমনকি ২০ কোটি রুপির সীমা অতিক্রম করার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে। যদিও তার ভিত্তি মূল্য ২ কোটি রুপি।
পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে পন্ত হয়তো সবার সেরা নন। ২০১৬ সালে আইপিএলে অভিষেকের পর থেকে ১১১ ম্যাচে মাত্র আটটি ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছেন। তবে তার এক্স-ফ্যাক্টর তাকে অনন্য করে তুলেছে। পন্তের ব্যাটিং সবসময়ই ভক্তদের জন্য কিছু চমক নিয়ে আসে।
শ্রেয়াস আইয়ার: ঋশভ পন্তের মত শ্রেয়াস আইয়ারও এবারের আইপিএল নিলামে বাজিমাত করতে পারে। ২০২২ সালের মেগা নিলামে ১২.২৫ কোটি রুপিতে শ্রেয়াসকে দলে ভিড়িয়েছিল কেকেআর। অধিনায়ক হয়ে এসে ২০২৪ সালের আইপিএল শিরোপাও এনে দেন তিনি। যদিও ২০২৩ সালে পিঠের চোটের কারণে আসর থেকে বাদ পড়েন।
২০২৪ সালে ফিরে এসে ভারতের কোচ গৌতম গম্ভীরের কোচিংয়ে খেলেন। যদিও কেকেআর তাকে রাখতে আগ্রহী ছিল, তবে আর্থিক বিষয় নিয়ে আলোচনা ভেস্তে যাওয়ায় শ্রেয়াস নিলামের পথে পা বাড়ান। শ্রেয়াস মিডল অর্ডারের কার্যকরী ব্যাটার, যাকে নিয়ে হতে পারে তুমুল প্রতিযোগিতা।
মিচেল স্টার্ক: শেষবার যখন মিচেল স্টার্ক আইপিএল নিলামে অংশ নিয়েছিলেন, তখন তিনি নতুন ইতিহাস গড়েছিলেন। প্যাট কামিন্সকে ২০.৫০ কোটি রুপিতে কিনে নেওয়ার কয়েক মিনিট পরেই সানরাইজার্স হায়দরাবাদের সেই রেকর্ড ভেঙে স্টার্ককে ২৪.৭৫ কোটি রুপিতে দলে নিয়েছিল কলকাতা নাইট রাইডার্স (কেকেআর)। এটি ছিল কেকেআরের বাজেটের ৮০%। লিগ পর্বে সাদামাটা পারফরম্যান্স দেখালেও প্লে-অফের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত।
৩৫ বছর বয়সী এই অস্ট্রেলিয়ান পেসার পাওয়ারপ্লে এবং ডেথ ওভারে সমানভাবে কার্যকর। তার বৈচিত্র্যময় বোলিং সামর্থ্য টি-টোয়েন্টি ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণী সময়গুলোতে দলকে সুবিধাজনক অবস্থায় রাখতে সহায়ক। ২০২৪ সালের আইপিএল ফাইনালের পর স্টার্ক জানিয়েছিলেন, তিনি তার ক্যারিয়ারের শেষ অংশে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেই বেশি মনোযোগ দেবেন।
স্টার্কের অভিজ্ঞতা তাকে শুধু একজন ম্যাচ উইনার নয়, নেতৃত্ব দিতেও পটু। ফলে, এবারের নিলামে স্টার্ককে দলে নিতে যে কোনো দলকেই বড়সড় বাজি ধরতে হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
লোকেশ রাহুল: নিলামের আরেক বড় তারকা কেএল রাহুল। আইপিএল ২০১৮ থেকে এখন পর্যন্ত ছয়টি মৌসুমে কেএল রাহুল ৫০০ রানের বেশি সংগ্রহ করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু (আরসিবি) তার সম্ভাব্য গন্তব্য হতে পারে। আরসিবি বর্তমানে একজন অভিজ্ঞ অধিনায়ক ও উইকেটরক্ষক-ব্যাটারের সন্ধানে রয়েছে। ২০২২-২৪ মৌসুমে দীনেশ কার্তিক এই ভূমিকা পালন করেছিলেন, তবে তার অবসর নেওয়ার পর এই শূন্যতা পূরণের জন্য রাহুল হতে পারেন একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান।
রাহুলের স্ট্রাইক রেট নিয়ে সমালোচনা থাকলেও, তিনি নিজের শক্তির জায়গা দেখিয়েছেন এবং ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করেছেন। তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা যে কোনো দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হতে পারে। রাহুলের ভিত্তি মূল্য ২ কোটি রুপি।
জস বাটলার: আইপিএল ২০২২ মৌসুম থেকে টপঅর্ডার ব্যাটারদের মধ্যে চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক জস বাটলার। এই সময়ে তিনি ব্যাট করেছেন ১৪৫ স্ট্রাইক রেটে, ৭১টি ছক্কা হাঁকিয়ে চতুর্থ সর্বোচ্চ ছক্কা মারার কৃতিত্ব অর্জন করেন।
৩৪ বছর বয়সী বাটলার সম্প্রতি তার কাফ ইনজুরির কারণে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন। তবে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের হয়ে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ৮৩ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলে তিনি প্রমাণ করেছেন যে তার ব্যাটিং ক্ষমতা এখনও অক্ষুণ্ণ। রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে ২০১৮ সাল থেকে মূলত ওপেনার হিসেবে খেলা বাটলার তার শক্তিশালী ব্যাটিং দক্ষতার জন্য বিখ্যাত। টি২০ বিশ্বকাপজয়ী ব্যাটলার শুধু একজন ব্যাটারই নন, নেতৃত্ব দিতেও পটু। তার অভিজ্ঞতা যে কোনো দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে কাজ করবে। এবারের আইপিএল নিলামে বাটলারকে ঘিরে বড় প্রতিযোগিতা হবে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আর্শদীপ সিং: ডেথ ওভারের নির্ভরযোগ্য অস্ত্র। ২০২২ থেকে ২০২৪ আইপিএল পর্যন্ত ডেথ ওভারে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন তিনি। এই সময়ে ভুবনেশ্বর কুমার (৬৪) ও টি নটরাজন (৬১)-এর পর আর্শদীপের ৫০টি ইয়র্কার সবচেয়ে বেশি। ইয়র্কার, ডেথ ওভারের দুর্দান্ত এক অস্ত্র, যা কিনা ব্যাটারদের পরীক্ষায় ফেলতে পারে। আর্শদীপের ইয়র্কারের ইকোনমি রেট মাত্র ৫.৭৬, যা বুমরাহর(৫.৩৮) কাছাকাছি।
গত তিন মৌসুমে ডেথ ওভারে আর্শদীপ ২৮টি উইকেট নিয়েছেন, যা হর্ষল প্যাটেলের (৫০ উইকেট) পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। পাওয়ারপ্লেতেও তার অবদান দুর্দান্ত। ২০২২ থেকে আইপিএল পর্যন্ত পাওয়ারপ্লেতে তার উইকেট সংখ্যা ২৪, যা এই সময়ে চতুর্থ সর্বোচ্চ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও আর্শদীপ নিজেকে ম্যাচ উইনার হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তার এমন পরিসংখ্যান তাকে এই বছরের আইপিএল নিলামে বড় ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর নজরে রাখবে।
লিয়াম লিভিংস্টোন: টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অনেক মারকুটে ব্যাটারই আছেন, কিন্তু লিয়াম লিভিংস্টোন যেন আলাদা একজন। ইংলিশ এই ব্যাটিং অলরাউন্ডার মাঝের ও শেষের ওভারগুলোতে বিধ্বংসী হয়ে উঠেন। গত তিন আইপিএলের মৌসুমে ১৯১.৬৬ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছেন যেখানে এই তালিকায় তার ঠিক সামনে রয়েছেন সূর্যকুমার যাদব (১৯৩.৮৫) এবং হেনরিখ ক্লাসেন (১৮২.৪০)।
বোলিংয়েও বেশ কার্যকর লিভিংস্টোন। একই ওভারে লেগ স্পিন এবং ফিঙ্গার স্পিন করতে পারেন, যা পরিস্থিতি অনুযায়ী ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ। তার শক্তি ও দক্ষতা তাকে আবারও বড় দর এনে দিতে পারে।
ইশান কিষান: ২০২২ সালের মেগা নিলামে ইশান কিষানকে ১৫.২৫ কোটি টাকায় দলে নেয় মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। সেই বছর তার পারফরম্যান্স প্রত্যাশা অনুযায়ী না হলেও, পরবর্তী দুই মৌসুমে তিনি ব্যাটিংয়ে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছেন। বিশেষ করে পাওয়ারপ্লেতে তার প্রভাব স্পষ্ট। ২০২৩ সালে, যেখানে মুম্বাই প্লে-অফে উঠেছিল, কিষান ১৫ ইনিংসে ৩৩৩ রান করেন, স্ট্রাইক রেট প্রায় ১৪৫। ২০২৪ সালে মুম্বাই টেবিলের নিচে থেকে শেষ করলেও, পাওয়ারপ্লেতে তার স্ট্রাইক রেট ছিল ১৬১-এর ওপরে, ১৩ ইনিংসে করেন ২৩৯ রান।
বাঁ-হাতি ওপেনার এবং উইকেটকিপার হিসেবে তার দক্ষতা তাকে আরও চাহিদাসম্পন্ন করে তুলেছে। তার বয়স মাত্র ২৬ হওয়ায় অনেক দল তাকে ভবিষ্যতের জন্যও বিনিয়োগ মনে করছে। ফলে, আসন্ন নিলামে তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি হতে পারে বড় দলগুলোর মধ্যে।
ফিল সল্ট: আইপিএলে নতুন হিটম্যান হতে পারে ফিল সল্ট। গত আইপিএলে সুনীল নারিনের ব্যাটিং সাফল্যের পেছনে অনেকটাই ছিল ফিল সল্টের অবদান, যিনি একের পর এক ঝলমলে স্ট্রোক খেলে নজর কেড়েছেন। ২০২২ সাল থেকে, টি২০ ক্রিকেটে প্রথম ছয় ওভারে শুধুমাত্র ট্র্যাভিস হেডের স্ট্রাইক রেট ফিল সল্টের চেয়ে বেশি, যদিও হেডের ম্যাচ সংখ্যা অনেক কম। ১৩১ ইনিংসে সল্টের রান ২৪৫০, এবং তার স্ট্রাইক রেট ১৬৩.৭৭।
বাউন্ডারি মারতে কার্পণ্য করেন না সল্ট। গত আইপিএলে প্রতি বলের জন্য বাউন্ডারি পাওয়ার গড় ছিল ২.৬১ (১৫ ইনিংসে)। পুরো মৌসুমে একমাত্র জেক ফ্রেজার-ম্যাকগার্ক, যিনি দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে ওপেনিং করেছেন, তার বাউন্ডারি গড় (২.০৪) ছিল সল্টের চেয়ে ভালো। সল্ট দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন প্রতি ছক্কার জন্য বলের গড়ে (৮.৭৭), যেখানে ফ্রেজার-ম্যাকগার্ক ছিলেন প্রথম (৫.০৫)। তাই সল্ট হতে পারেন বড় দলগুলোর হটকেক।
জেক ফ্রেজার-ম্যাকগার্ক: আইপিএলের গত মৌসুমের সেনসেশন অস্ট্রেলিয়ার এই মারকুটে ব্যাটার। ২২ বছর বয়সী ম্যাকগার্ক স্ট্যান্স নেন বেসবলের ব্যাটাদের মত। প্রায় প্রতি ম্যাচের শুরুতেই দিল্লিকে বিস্ফোরক পুঁজি এনে দিয়েছেন। লিস্ট এ ক্রিকেটে সবচেয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড (২৯ বলে) তার দখলে। এই রেকর্ড গড়তে তিনি ভাঙেন এবি ডি ভিলিয়ার্সের ৩১ বলে সেঞ্চুরির রেকর্ড।