আলি আবরার
যশোর জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ থানা অভয়নগর। বাংলাদেশের আর পাঁচটি গ্রামের মতোই সাধারণ একটি গ্রাম এটি। ভৈরব নদের পাড়ে অবস্থিত গ্রামটি। এই সাদামাটা অভয়নগর সেই ইংরেজ আমলে কীভাবে বাংলাদেশের একেবারে প্রথম দিককার একটি থানা হয়ে উঠেছিল তা জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আরো কয়েকশো বছর পূর্বে।
মুঘলদের সাথে যুদ্ধে প্রতাপশালী যশোর রাজ্যের রাজা প্রতাপাদিত্য পরাজিত ও বন্দী হন। ফলে রাজপরিবারের সদস্যরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন ভাগ্যান্বেষণে। তাদের একজন ঠাই নিয়েছিলেন যশোরের চাচড়া অঞ্চলে। এদের উত্তরপুরুষ রাজা নীলকণ্ঠ রায়। পরিশ্রম করে নিজের ভাগ্য ফিরিয়েছিলেন। ধন-দৌলত আর শক্তি-সামর্থে সবার সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি।
এই নীলকণ্ঠ রায়ের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেছিলো এক কন্যাসন্তান। রাজকন্যার নাম ছিলো অভয়া। যশোরের তৎকালীন রাজা নীলকণ্ঠ রায়ের একমাত্র কন্যা ছিলেন তিনি। ভৈরব নদের তীরে ভাটপাড়ার পাশেই ছিলো রাজার দুর্গ। সেখানকার প্রকৃতির মাঝেই বেড়ে ওঠেন রাজার নয়নের মণি অভয়া। একসময় তার বিয়ের বয়স হয়ে গেলো। রাজা মেয়ের বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিভিন্ন জায়গার রাজপরিবার থেকে অভয়ার বিয়ের সম্বন্ধ আসতে থাকে।
শেষপর্যন্ত রাজা নীলকণ্ঠ ঠিক করলেন তখনকার সময়ের প্রভাবশালী নড়াইল জমিদার বংশের পুত্র নীলাম্বর রায়ের সঙ্গেই অভয়ার বিয়ে দেবেন। বিয়ের সানাই বাজল রাজদুর্গে। স্বামীর সঙ্গে বেশ ভালোই কাটছিলো অভয়ার সংসার। তখনো তারা একে অন্যকে মন দেয়া-নেয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অভয়ার স্বামী নীলাম্বর রায় কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। কিছুদিনের মধ্যে তার মৃত্যু হয়।
রাজা নীলাম্বরের একমাত্র কন্যা অভয়া বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই বিধবা হন। রাজকন্যা ছিলেন শৈব অর্থাৎ মহাদেব শিবের উপাসক। সে সময়ে হিন্দু ধর্মে দ্বিতীয় বিয়ের নিয়ম না থাকায় অভয়া বাকি জীবন পূজা-অর্চনা করে কাটাতে চান।
নীলকন্ঠ রায় মেয়ের ইচ্ছা শুনে ১৭৪৫ সাল থেকে ১৭৬৪ সালের মধ্যে রাজবাড়ির সন্নিকটে মেয়ের জন্য মন্দির নির্মাণ করে দেন। একটি-দুটি নয়, ৬০ একর জায়গার উপর ১১টি শিব মন্দির নির্মাণ করেন তিনি। আর মেয়ের নাম অনুসারে নগরের নাম রাখেন অভয়ানগর, যা কালক্রমে পরিচয় পেয়েছে অভয়নগর নামে। ভৈরব নদের তীরে এখনো দাঁড়িয়ে আছে সেই স্থাপনা। এটি শুধুমাত্র একটি সুন্দর মন্দিরই নয়, একই স্থানে এতগুলো শিব মন্দির বাংলাদেশে আর কোথাও নেই।
রাজকন্যা সারাদিন সেখানেই শিবের ভক্তি করতেন। মনের কষ্টে ঢুকরে কেঁদে উঠতেন অভয়া। তার কান্নার শব্দ যেন প্রকৃতিও সহ্য করতে পারতো না। এভাবেই দুঃখী রাজকন্যা বাকিটা জীবন পার করেন। কথিত আছে, আজো না-কি রাতের বেলায় কোনো নারীর কান্নার শব্দ শোনা যায় মন্দিরের ভেতর থেকে।
১১ শিব মন্দিরের বিবরণ
১৭ শতকের মাঝামাঝি রাজা নীলকণ্ঠ রায় ৬০ একর জায়গার উপর ১১টি শিব মন্দির নির্মাণ করেন। মেয়ের নাম অনুসারে ওই স্থানের নাম রাখেন অভয়নগর। যা কালক্রমে পরিচয় পেয়েছে অভয়নগর নামে। ভৈরব নদের তীরে এখনো দাঁড়িয়ে আছে ১১টি শিব মন্দির। একই স্থানে এতগুলো শিব মন্দির বাংলাদেশে আর কোথাও নেই।
যশোর জেলায় অবস্থিত এ প্রাচীন মন্দিরগুলো বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। অভয়নগর উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের ভৈরব নদীর তীরে স্থাপনাটি দেখতে দর্শনার্থীরা সব সময়ই ভিড় জমান। যশোর সদর উপজেলা থেকে এর দূরত্ব ৪৫ কিলোমিটার।
রাজা নীলকণ্ঠ রায় মন্দিরগুলো নির্মাণে ব্রিটিশ আমলের চুন-সুরকি এবং ইটের ব্যবহার করেছেন। সব মিলিয়ে ১১টি মন্দির। ১১টি মন্দিরের মধ্যে সর্ব উত্তরের মন্দিরটি মূল মন্দির। মূল মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ২৪ ফুট ৪ ইঞ্চি ও প্রস্থ ২২ ফুট ৩ ইঞ্চি। দেয়ালের প্রস্ত ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি। প্রধান মন্দিরের দুই পাশে পূর্ব ও পশ্চিমে ৪টি করে মোট ৮টি ও প্রবেশপথের দুই দিকে ২টিসহ মোট ১০টি অপ্রধান মন্দির রয়েছে। ১১টি মন্দিরে রয়েছে ১১টি কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ ছিল যা চুরি হয়ে যায়। মন্দিরের বাইরে দক্ষিণ দিকে আছে একটি প্রধান প্রবেশপথ। প্রতিটি মন্দিরে প্রবেশের জন্য আছে খিলানাকৃতির দরজা ও দেয়ালে পোড়ামাটির ফলক ও অনিন্দ্যসুন্দর কারুকাজ। মন্দিরের চারদিকে প্রাচীর বেষ্টিত। উত্তর-পশ্চিম কোণে একসময় পুকুর ছিল
মন্দিরের ছাঁদগুলো নির্মিত হয়েছে উলম্ব ধরনের ডোমের সমন্বয়ে। অর্থাৎ দুই স্তরে নির্মিত ছাদের ভেতরে গোলাকার এবং বাইরে চালা রীতিতে নির্মিত। সবগুলো মন্দির নির্মাণে স্থানীয় উপকরণ, নির্মাণশৈলী এবং দক্ষতার ছাপ মেলে। মন্দিরের চারপাশে একসময় প্রাচীর দেয়া থাকলেও এখন তার চিহ্নও নেই।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রথম ১১ শিব মন্দিরের সংস্কার কাজে হাত দেয়। ৩ বছরের মাথায় অর্থাৎ ২০১৭ সালে শেষ হয় মন্দিরগুলোর সংস্কারের কাজ। এ কারণেই কালের সাক্ষী মন্দিরগুলো ভগ্নদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে। শিব মন্দিরগুলো দেখতে এখন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা ঘুরতে আসেন অভয়নগরে।
এএপি/পিএসএন/এইচ-১