নতুন এই বছরের শেষ নাগাদ দেশের পরিবহন খাতে কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে দেশে সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগের চিত্র অনেকটাই বদলে যাবে। উন্মোচিত হবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের নতুন নতুন পথ।
দীর্ঘতম রেল সেতু, প্রথম মেট্রোরেল ও নদীর তলদেশে টানেলসহ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পগুলো বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের তালিকায় স্থান পেতে সহায়তা করবে।
প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পথে অনাকাঙ্ক্ষিত বিভিন্ন বাধা এসেছে। তহবিল সংকট, নকশা নিয়ে জটিলতা এবং করোনা মহামারির কারণে নজিরবিহীন সংকটে প্রকল্পের সময়সীমা ও খরচ বেড়েছে।
তারপরও, দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে পরিচালিত বহু প্রতীক্ষিত এই অবকাঠামোগুলো এ বছরেই জনগণের জন্য উন্মুক্ত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।
বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) ও প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশা, আংশিকভাবে হলেও এগুলোও এ বছরই চালু হয়ে যেতে পারে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এই প্রকল্পগুলো পরবর্তী পর্যায়ে দেশের উন্নয়নের অগ্রদূত হিসেবে কাজ করবে।’
‘তবে বারবার বাজেট বৃদ্ধি ও সময়সীমা পরিবর্তনের কারণে উচ্ছ্বাস কিছুটা কমে গেছে। এটি একই সঙ্গে আমাদের পরিকল্পনার দুর্বলতাকে এবং সম্ভাব্য সময়সীমা সম্পর্কে আমাদের ধ্যানধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে।’
বড় সেতু, বড় স্বপ্ন
সরকারের ৩০ হাজার কোটি টাকার নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু জুনে চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নব্বইয়ের দশক থেকেই ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু নিয়ে কথা হচ্ছে। সরকার ২০০৭ এর আগস্টে ১০ হাজার ১৯১ কোটি টাকার এই প্রকল্পের অনুমোদন দেয়।
তবে স্বপ্নের প্রকল্পটি ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে হোঁচট খায়। মূল দাতা সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুত ঋণ স্থগিত করে। অভিযোগটি পরবর্তীকালে কানাডার একটি আদালত নাকচ করে দিলেও ততদিনে অন্যান্য দাতারা তাদের তহবিল বাতিল করে দেয়।
তারপর ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সাহসী সিদ্ধান্ত নেন।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সেতুর প্রথম স্প্যানটি বসানো হয়। প্রকল্পের কাজ তখন পর্যন্ত মসৃণভাবে এগিয়ে চললেও পরে পিলারের নকশা নিয়ে জটিলতা ও মহামারির কারণে সার্বিকভাবে কার্যক্রমের গতি ধীর হয়ে যায়।
আশা করা হচ্ছে, সড়ক ও রেলপথ সম্বলিত সেতুটি দেশের বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ অবদান রাখবে এবং দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াবে।
বৈদ্যুতিক রেলগাড়ির যুগ
মেট্রোরেল প্রকল্পের কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈদ্যুতিক রেলগাড়ির যুগে প্রবেশ করবে।
সরকার ভয়াবহ ট্রাফিক সমস্যা ও পরিবেশ দূষণ কমানোর জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে রাজধানী ও এর আশেপাশের প্রায় ১৩০ কিমি এলাকায় ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রো রেল নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনা করেছে। মোট ৬টি মেট্রো লাইন থাকবে, যার মধ্যে এলিভেটেড (মাটি থেকে ওপরে) ও মাটির নিচে দিয়ে তৈরি লাইন উভয়ই থাকবে।
ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন তৈরির ধারণার কথা প্রথম শোনা যায় ২০০৫ সালে। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীতে মেট্রো রেল নেটওয়ার্ক তৈরির প্রথম প্রকল্প অনুমোদন পায়।
আনুষ্ঠানিকভাবে এমআরটি লাইন ৬ নামে পরিচিত প্রথম মেট্রো লাইন উত্তরা তৃতীয় ফেজ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মিত হচ্ছে। এর ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা।
৮ সেট মেট্রো ট্রেন ইতোমধ্যে ঢাকায় পৌঁছেছে। বর্তমানে সেগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) জানিয়েছে তারা সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব ধরনের যাচাই বাছাই শেষ করে ডিসেম্বর থেকে উত্তরা-আগারগাঁও রুটে প্রথম পর্যায়ের পরিবহন কার্যক্রম শুরু করবে।
১৬টি স্টেশনের এমআরটি লাইন ৬ দিয়ে প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার মানুষ চলাচল করতে পারবেন। ফলে, উত্তরা থেকে মতিঝিলে যাতায়াতের সময় ২ ঘণ্টা থেকে প্রায় ৪০ মিনিটে নেমে আসবে।
অধ্যাপক শামসুল জানান, মেট্রোরেলের কার্যক্রম শুরু হলে উচ্চবিত্তরাও চলাচলের বাহন বদলাতে পারে। ফলে সড়কে ছোট গাড়ির সংখ্যা কমতে পারে, যার ফলে যানজটও কমতে পারে।
পানির নিচের বিস্ময়
চট্টগ্রামের দুটি অংশকে সংযুক্ত করতে কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল নির্মাণের কাজ চলছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এটি হবে প্রথম পানির নিচের টানেল।
৯ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলটি নির্মাণে খরচ হচ্ছে ১০ হাজার ২৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মাধ্যমে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে একটি অত্যাধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে এবং এটি একই সঙ্গে এশিয়ান মহাসড়কের সঙ্গেও যুক্ত হবে।
যদিও প্রকল্পটি ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায়, তবুও এর মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু হতে হতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত লেগে যায়।
সম্প্রতি এই প্রকল্পের বর্তমান সময়সীমা ২০২২ এর ডিসেম্বর থেকে আরও ৬ মাস বাড়ানোর আবেদন জানানো হয়েছে। তবে কর্মকর্তারা বলছেন যে তারা টানেলটি এ বছরের মধ্যেই সবার জন্য উন্মুক্ত করতে পারবেন।
যাত্রীদের স্বস্তি
২০১২ সালে সরকার ঢাকার দীর্ঘদিনের যানজট সমস্যা কমিয়ে আনার জন্য একটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়।
বেশ কয়েকবার সময়সীমা পরিবর্তনের পর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নির্মাণাধীন এই প্রকল্পের কর্তৃপক্ষ ডিসেম্বর থেকে বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও রেল স্টেশন পর্যন্ত আংশিকভাবে এর কার্যক্রম শুরু করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত বিস্তৃত ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে মানুষকে শহরের যানজট এড়িয়ে ঢাকা পার হয়ে যাওয়ার সুযোগ দেবে।
এ ছাড়াও বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) সেবাও ডিসেম্বরে চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
২০১২ সালের নভেম্বরে ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বাস করিডর নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, যেটি মানুষকে ঢাকা থেকে গাজীপুরে পৌঁছে দিতে পারবে। এর কাজ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন জটিলতায় আজও তা হয়নি।
১০০টি নতুন বাস নিয়ে এই সেবা চালু হবে, যার মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় ২০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। এই করিডরে ২৫টি স্টেশন থাকবে।
তবে কর্মকর্তারা জানান, নির্ধারিত সময়সীমা অনুযায়ী কাজ শেষ করার ক্ষেত্রে অনেকগুলো নিয়ামক রয়েছে, বিশেষ করে করোনা মহামারি। যদি করোনা পরিস্থিতির আবারও অবনতি হয়, তাহলে কিছু প্রকল্পের কাজ সময়মত শেষ করা বেশ কঠিন হবে।
পিএসএন/এমঅাই