বিশ্বে বহু ধর্ম রয়েছে। এসব ধর্মের অনুসারীদের রয়েছে আলাদা আলাদা পবিত্র স্থান ও নিদর্শন। যা তাদের নিজ নিজ ধর্ম-বিশ্বাস অনুযায়ী সবচেয়ে পবিত্র ও মূল্যবান। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান ও প্রভাবশালী ধর্ম ইসলাম। এরও বেশ কিছু পবিত্র স্থান ও নিদর্শন রয়েছে এবং সেগুলো এ ধর্মের অনুসারী মুসলিমদের কাছে ধর্মীয়ভাবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর তেমনি একটি নিদর্শন। যা ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর জন্মভূমি মক্কা শহরের পবিত্র কাবা শরিফের অন্যতম আকর্ষণ।
ইসলামের ইতিহাস ও হাদিস মতে, আলোচ্য হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর এক সময় ধবধবে সাদা ছিল। কিন্তু কালক্রমে তা কালো রং ধারণ করেছে। হাজরে আসওয়াদের ইতিহাসের পাশাপাশি সাদা পাথর কীভাবে কালো হলো-এখানে সে বিষয়েই সম্যক আলোকপাক করা হয়েছে।
হাজরে আসওয়াদের ইতিহাস
পবিত্র কাবা শরিফ ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র স্থান। যা বর্তমান সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা শহরে অবস্থিত। সারাবিশ্বের মুসলিমরা এর দিকে মুখ করেই প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। এছাড়া প্রতিবছর লাখ লাখ মুসলিম পবিত্র হজ ও ওমরাহ পালনের সময় এর চারপাশে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।
আল্লাহর ঘর খ্যাত পবিত্র কাবা শরিফের পূর্ব কোণে ভূমি থেকে প্রায় ৫ ফুট উপরে দরজায় অনতিদূরে দেয়ালের মধ্যে বসানো রয়েছে হাজরে আসওয়াদ। এ কোণটিকে ‘রোকনে হাজরে আসওয়াদ’ বলা হয়। মূলত এই কোণ থেকেই হজ ও ওমরাহ পালনকারীদের তাওয়াফ শুরু হয়। আবার এ কোণে এসেই তাওয়াফ শেষ হয়। হজ বা ওমরাহর বিভিন্ন রীতির মধ্যে মধ্যে এ কালো পাথরে হাত স্থাপন ও চুম্বন অন্যতম।
হাজরে আসওয়াদের উৎপত্তি তথা এটা কোথা থেকে এলো তা নিয়ে ইসলামের ইতিহাসে একাধিক তথ্য রয়েছে। কোথাও কোথাও বলা হয়েছে, হজরত আদম (আ.)-কে যখন পৃথিবীতে পাঠানো হয়, তখন প্রথম মসজিদটি কোথায় নির্মাণ করা হবে সেটা দেখাতে মহান আল্লাহর নির্দেশক্রমে বেহেশত থেকে হাজরে আসওয়াদ পৃথিবীতে পতিত হয়। তবে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বর্ণনা মতে, মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহীম (আ.) যখন পবিত্র কাবা ঘর নির্মাণ করেন, তখন নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে পাথরটি সংগ্রহ করা হয়।
ইবনে কাসীরের তারিখে মক্কার তথ্য মতে, ছেলে ইসমাঈল (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে পবিত্র কাবা নির্মাণ করেন ইব্রাহীম (আ.)। কাবা ঘর নির্মাণ যখন প্রায় শেষ তখন ইব্রাহীম (আ.) খেয়াল করেন, দেয়ালের এক জায়গায় তখনও একটু ফাঁক রয়ে গেছে।
তখন ছেলে ইসমাইলকে (আ.) একটি উপযুক্ত পাথর খুঁজে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন ইব্রাহিম (আ.)। বাবার নির্দেশে পাথরের সন্ধানে বের হন ছেলে। কিন্তু মক্কার চারপাশে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও দেয়ালে ঠিক ঠিক লেগে যায় তেমন উপযুক্ত কোনো পাথর পাননি ইসমাইল (আ.)। না পেয়ে ফিরে আসেন তিনি। এসেই দেখেন কাবার দেয়ালের ওই নির্দিষ্ট স্থানে একটি মনোরম পাথর লাগানো হয়েছে। ইসমাইল (আ.) বাবার কাছে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.)-এর মাধ্যমে পাথরটি পাঠানো হয়েছে।
সাদা পাথর কালো হলো যেভাবে
হাজরে আসওয়াদ দুটো আরবি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। হাজর শব্দের অর্থ পাথর। আর আসওয়াদ অর্থ কালো। হাজরে আসওয়াদ অর্থ কালো পাথর। বর্তমানে হাজরে আসওয়াদ দেখতে কুচকুচে কালো। কিন্তু এক সময় এ পাথর ধবধবে সাদা ছিল। এ কথা বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (স.) নিজেই বলেছেন।
হাজরে আসওয়াদের প্রকৃত রং, এর পবিত্রতা ও এটা যে একটি বেহেশতি পাথর সে বিষয়ে বিশ্বনবীর (স.) একাধিক হাদিস রয়েছে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘হাজরে আসওয়াদ যখন জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আসে, তখন এটি দুধের চেয়েও সাদা ছিল। কিন্তু আদম সন্তানের পাপ এটাকে কালো করে ফেলেছে।’ (তিরমিজি, ইবজে খুজায়মা, মিশকাত, তালিকুর রাগিব)।
হাজরে আসওয়াদ একটি আলোকপ্রভা, উজ্জ্বল পাথর ছিল। যার আলোকে নিষ্প্রভ করে দেয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে- হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহকে (স.) আমি বলতে শুনেছি, ‘হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহিম জান্নাতের ইয়াকুতসমুহের (দীপ্তিশীল মূল্যবান মণি) অন্তর্গত। আল্লাহ্ তাআলা এই দুটি পাথরের আলোকপ্রভা নিম্প্রভ করে দিয়েছেন। এ দুটির আলোকপ্রভা যদি তিনি নিস্তেজ করে না দিতেন তাহলে তা পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে যা কিছু আছে সব আলোকিত করে দিত।’ (তিরমিজি, মিশকাত)।
বিশ্বনবীর (স.) উপরোক্ত হাদিস দুটি থেকেই প্রমাণ হয়, হাজরে আসওয়াদ সত্যিই জান্নাত থেকে এসেছে। এবং এর আসল রং ধবধবে সাদা। আর তা মানুষের গুনাহের কারণে ধীরে ধীরে কালোতে পরিণত হয়। এ ছাড়া ইসলামপূর্ব যুগে একবার কাবা শরিফের গিলাফ পুড়ে গিয়েছিল। তখন এ হাজরে আসওয়াদও পুড়ে যায়। ফলে তার কৃষ্ণতা আরও বৃদ্ধি পায়।
হাজরে আসওয়াদে বিশ্বনবীর (স.) স্মৃতি
কাবা শরিফের অবস্থান মূলত পবিত্র মক্কা শহরের ফারহান উপত্যকার গহীরে। ফলে প্রায় প্রতিবছরই বন্যা কবলিত হতো পবিত্র কাবা। একবার প্রবল বৃষ্টিপাত সৃষ্ট বন্যায় কাবার ভিত্তি অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্থানচ্যুত হয় হাজরে আসওয়াদও।
কাবা ঘর দেখভালের দায়িত্ব তখন মক্কার সবচেয়ে প্রভাবশালী গোত্র বা বংশ কুরাইশদের। নতুন করে নির্মাণের মাধ্যমে এর ভিত্তি শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কুরাইশ গোত্রের প্রতিটি পরিবার কাবা ঘরের একটি নির্দিষ্ট অংশ নির্মাণের দায়িত্ব পায়। কাবা ঘর নির্মাণ এক সময় শেষ হয়। কিন্তু বিপত্তি বাধে হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে। কুরাইশ বংশের প্রত্যেক নেতাই কালো পাথর স্থাপনের গৌরবের ভাগীদার হতে চান।
এ নিয়ে মতানৈক্য ও দ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে, তা সময় মতো না ঠেকালে সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা। এমনি পরিস্থিতিতে একদিন এক নেতা সবার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তোমরা শান্ত হও। আমার একটা পরামর্শ আছে। আমরা আগামীকাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব এবং নজর রাখব, কে সর্বপ্রথম কাবা ঘরে প্রবেশ করে। কাল সকালে যে লোক সর্বপ্রথম কাবা ঘরে প্রবেশ করবে, তিনিই এ সমস্যা সমাধান করবেন।’
তার প্রস্তাবে সবাই সম্মত হলেন। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (স.) তখন পরিণত যুবক। দেখা গেল, আরবের আল- আমিন খ্যাত মুহাম্মদই (স.) প্রথম কাবা ঘরে এলেন। ঘটনার বর্ণনা করে সবাই তার কাছেই সমাধান চাইলেন।
বিশ্বনবী (স.) তখন তাৎক্ষলিক এর একটা সমাধান বের করলেন। প্রত্যেক গোত্র একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে পাথরের কাছে গেলেন। এরপর বিশ্বনবী তার নিজের চাদর বিছিয়ে স্বহস্তে হাজরে আসওয়াদ তুলে তার মাঝে রাখলেন। এবার গোত্রের প্রতিনিধিদের বললেন, সবাই চাদরখানা ধরে পাথরটি যথাস্থানে নিয়ে চলুন। নবীর চমৎকার পদ্ধতিতে সন্তুষ্ট হয়ে সবাই তাই করলেন।
হাজরে আসওয়াদ জান্নাতের পাথর। হজরত জিব্রাইল ফেরেশতা থেকে শুরু করে হজরত আদম (আ.), ইব্রাহীম (আ.), ইসমাইল (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত। অতএব এ পবিত্র পাথর ভাবী বিশ্বনবীর পবিত্র হাতেই যথাস্থানে স্থাপিত হলো।
হাজরে আসওয়াদ চুরি
কাবা শরিফ থেকে হাজরে আসওয়াদ একবার চুরি হয়ে যায়। এটাকে আবার কাবা শরিফে ফিরিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়। তবে এজন্য দীর্ঘ ২৩ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ৯৩০ সালে বাহরাইনের কারমাতিয়ানরা এটি চুরি করে। আর এ চুরির নেতৃত্ব দেন কারমাতিয়ান নেতা আবু তাহির আল-কারমাতি। চুরি করে এটাকে তিনি তৎকালীন হাজারবেসে (বর্তমানে বাহরাইন) নিয়ে যান।
আবু তাহির আল-কারমাতির ভাই আবু সাদ হাসান ইবনে বাহরাম আল-জান্নাবী ছিলেন কারমাতিয়ান রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তার মৃত্যুর পর আবু তাহির আল-কারমাতি ৯২৩ খ্রিস্টাব্দে কারমাতিয়ানদের নেতা হন। তার শাসনামলে কারমাতিয়ান রাজ্যের কিছুটা বিস্তৃতি ঘটে। ৯২৩ সালে বসরায় ও ৯২৭ সালে কুফায় অভিযান চালান আবু তাহের। এভাবে ইরাকের বেশিরভাগ অঞ্চল তিনি দখল করে নেন।
যেভাবে কারমাতিয়ানরা হাজরে আসওয়াদ চুরি করে
৯৩০ সালে আবু তাহির একটি ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনাটি হলো পবিত্র মক্কা নগরী আক্রমণ করার। পরিকল্পনা মতো তিনি প্রথমে মক্কা নগরীর উপকণ্ঠে পৌঁছান। কিন্তু নগরীতে প্রবেশে ব্যাপক বাধার মুখে পড়েন তিনি। তবে তিনি মক্কা নগরীতে কোনো বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করবেন না-এই শর্তে তাকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়।
কিন্তু মক্কা প্রবেশের পর নিজের শপথ রক্ষা করেননি আবু তাহের। মক্কায় প্রবেশের পর তিনি যা করেন মোটেও শান্তির বার্তা ছিল না। হজের প্রথম দিনেই তার পরিকল্পনা মতো কারমাতিয়ানরা পবিত্র মক্কা নগরীকে আক্রমণ করে বসে এবং রীতিমতো ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সেনা ও অশ্বারোহী বাহিনী মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে। তারা হজ পালকারীদের নির্মমভাবে গণহত্যা করে। কারমাতিয়ান সেনাদের হাতে কাবা শরিফ ঘিরে নামাজ পড়তে থাকা প্রায় ৩০ হাজার হাজি নিহত হন।
এরপর তারা পবিত্র কাবা ঘর লুটের জঘন্য কাজটি করে। চুরি করে পবিত্র হাজরে আসওয়াদ। কারমানতিয়ানদের নেতা আবু তাহির পাথরটি তার নিজ দেশে নিয়ে যান। তার ইচ্ছে ছিল, হাজারবেসের ‘মসজিদ আল দিরার’-এর দেয়ালে স্থাপন করা।
মসজিদটি আগেই তৈরি করেছিলেন আবু তাহির। এতে হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করে একে একটি পবিত্র স্থান করতে চেয়েছিলেন তিনি। যাতে লোকে কাবা শরিফকে বাদ দিয়ে ‘মসজিদ আল দিরার’কে হজের স্থান হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু তার এ দুরভিসন্ধি এক মুহূর্তের জন্যও বাস্তবায়ন হয়নি। অবশেষে হাজরে আসওয়াদ চুরি হওয়ার দীর্ঘ ২৩ বছর পর আব্বাসীয় শাসনামলে বিশাল মুক্তিপণের বিনিময়ে পাথরটি আবার ফিরিয়ে আনা হয় এবং আবারও পবিত্র কাবার আগের স্থানে স্থাপন করা হয়।
ইসলামে হাজরে আসওয়াদ যে কারণে এত গুরুত্বপূর্ণ
হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে এসেছে। এ ছাড়া এ পাথরের পবিত্রতা নিয়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর একাধিক বক্তব্য ইসলামে এর গুরুত্ব ও মর্যাদা বেড়েছে। বিশ্বনবী (স) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ করে বলছি, সত্যই আল্লাহ শেষ বিচারের দিন হাজরে আসওয়াদ পাথরটি এমনভাবে উপস্থাপন করবেন যে এর দুটো চোখ ও একটি জিহবা থাকবে। তারা ওইসব লোকের পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবে যারা পাথরটিকে সঠিকভাবে চুম্বন করেছে।’ (তিরমিযী)
তবে মুসলিমরা হাজরে আসওয়াদকে ভালো-মন্দের মালিক মনে করে না। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত উমরের (রা.) এ কথাটিতেই সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়। কালো পাথরকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন, ‘আমি ভালো করেই জানি, তুমি একটি পাথর মাত্র। তুমি আমাদের ভালো-মন্দের, লাভ-লোকসানের মালিক নও। বিশ্বনবীকে (স) চুম্বন দিতে না দেখলে আমি তোমায় চুম্বন দিতাম না।’ (বুখারী)
কালো পাথর চুম্বনের তাৎপর্য হচ্ছে, এটা আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার নিদর্শন। পাথর চুম্বনের দ্বিতীয় তাৎপর্য হচ্ছে, একই পাথরে একই স্থানে লাখ লাখ মুসলিমের চুম্বনে রাজায়-প্রজায়, মালিকে-শ্রমিকে, শিক্ষিতে-অশিক্ষিতে, আরব-অনারবে, কালো-সাদার, ধনী-নির্ধনে, ছুত-অচ্ছুতের মধ্যে বিভেদের জঘন্য প্রাচীর ভেঙে যায়।
পিএসএন/এমঅাই