দোজাহানের সর্দার বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর আদরের দুই নাতি হজরত হাসান ও হোসাইন (রা.)। নবীজি (স.) তাদের খুব ভালোবাসতেন। তাদের জন্মের পর কানে আজান দেওয়া, তাদের জন্য নিজে ভেড়া জবাই করে আকিকা দেওয়া, নাতিদের বিপদ মুক্তির জন্য সদকা করা, দীনি শিক্ষা দেওয়া, মসজিদে নিয়ে যাওয়া, উত্তম আচার-ব্যবহার শেখানো সব দায়িত্ব নিজের করে নিয়েছিলেন নবীজি।
নাতিদের সঙ্গে খেলতেন তিনি। তারা প্রস্রাব করলেও রাগ করতেন না। লুবাবা বিনতে হারিস (রা.) বলেন, ‘একবার শিশু হুসাইন (রা.) রাসুল (স.)-এর কোলে প্রস্রাব করে দিল। তখন আমি বললাম, অন্য একটি কাপড় পরে নিন। আপনার এ লুঙ্গিটি আমাকে দিন, আমি ধুয়ে দিচ্ছি।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৩৭৫)
নবীজি (স.) নাতিদের চুমো খেতেন। তাদের জন্য রহমতের দোয়া করতেন। উসামা ইবনে জায়েদ (রা.) বলেন, ‘রাসুল (স.) আমার হাত ধরে তাঁর এক রানের ওপর আমাকে এবং অন্য রানে হাসানকে বসাতেন। তারপর দুজনকে একত্রে মিলিয়ে নিয়ে বলতেন, ‘আল্লাহুম্মারহাম হুমা, ফা ইন্নি আরহামুহুমা’ (হে আল্লাহ, আপনি এদের দুজনের ওপর রহম করুন, কেননা আমিও এদের ভালোবাসি)।’ (বুখারি: ৬০০৩)
রাসুল (স.) বাহনে চড়ে নাতিদের ঘোরাতেন। তাঁদের সঙ্গে আনন্দঘন সময় কাটাতেন। সালামা (র.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর সাদা খচ্চরটির ওপর রাসুল (স.) নিজে এবং তাঁর দুই নাতি হাসান-হোসাইন সামনে-পেছনে বসা ছিলেন। আমি খচ্চরকে টেনে তাঁর ঘরে প্রবেশ করালাম।’ (সহিহ মুসলিম: ২৪২৩)
মানবসভ্যতায় ফুলকে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে দেখা হয়। প্রিয়নবী (স.) তাঁর দুই দৌহিত্রকে ফুলের উপমা দিয়ে আমাদের বুঝিয়েছেন যে তিনি তাঁদের কতটা ভালোবাসতেন। ইরশাদ হয়েছে, হাসান ও হোসাইন দুজন এই পৃথিবীতে আমার দুটি সুগন্ধময় ফুল। (তিরমিজি: ৩৭৭০)
হজরত হাসান ও হোসাইন (রা.)-এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো- তারা শারীরিক গঠনে অনেকটা রাসুল (সা.)-এর মতো ছিল। এ ব্যাপারে হজরত আলি (রা.) বলেন, ‘হাসান হলো (চেহারা- আকৃতি-অবয়বে) রাসুল (স.)-এর বক্ষ হতে মাথা পর্যন্ত অংশের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আর হোসাইন রাসুলুল্লাহ (স.)-এর শরীর মোবারকের অবশিষ্ট নিচের অংশের (বক্ষ মুবারক হতে নীচ পর্যন্ত) সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।’ (তিরমিজি: ৫৭৭৯; মুসনাদে আহমদ: ১/৯৯; মুজামুল কবির: ৩/২৯ হা: ২৫৭)
হজরত হাসান ও হোসাইন (রা.) জান্নাতে যুবকদের সর্দার হবেন। রাসুলুল্লাহ (স.) একবার বললেন, আজ রাতে একজন ফেরেশতা অবতরণ করেছে, যে আর কখনো আসেনি।… সে আমাকে সুসংবাদ শুনিয়েছে- ফাতেমা হবে, জান্নাতি নারীদের সরদার আর হাসান-হুসাইন হবে জান্নাতের যুবকদের সরদার।’ (তিরমিজি: ৩৭৮১)
তাঁদের প্রতি রাসুল (স.)-এর ভালোবাসা এতটাই গভীর ছিল যে, যারা তাঁদের দুজনকে ভালোবাসবে তাদের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। উসামা ইবনে জায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত, এক রাতে আমার কোনো প্রয়োজনে নবী (সা.)-এর কাছে গেলাম। অতএব নবী (স.) এমন অবস্থায় বাইরে এলেন যে একটা কিছু তাঁর পিঠে জড়ানো ছিল, যা আমি অবগত ছিলাম না। আমি আমার প্রয়োজন সেরে অবসর হয়ে প্রশ্ন করলাম, আপনার দেহের সঙ্গে জড়ানো এটা কী?
তিনি পরিধেয় বস্ত্র উন্মুক্ত করলে দেখা গেল তাঁর দুই কোলে হাসান ও হুসাইন (রা.)। তিনি বলেন, এরা দুজন আমার পুত্র (দৌহিত্র) এবং আমার কন্যার পুত্র। হে আল্লাহ! আমি এদের দুজনকে ভালোবাসি। সুতরাং তুমি তাদের ভালোবাসো এবং যে ব্যক্তি এদের ভালোবাসবে, তুমি তাদেরও ভালোবাসো। (তিরমিজি: ৩৭৬৯)
হুসাইন (রা.)-এর প্রতি রাসুল (সা.)-এর অকৃত্রিম ভালোবাসার মাত্রা কতটুকু, তা আরেকটি ঘটনা দ্বারা উপলব্ধি করা যায়। একদিন হোসাইন (রা.) গলির মধ্যে খেলছিলেন। প্রিয়নবী (স.) সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি লোকদের অগ্রভাগে এগিয়ে গেলেন এবং তাঁর দুই হাত প্রসারিত করে দিলেন। বালকটি এদিক-ওদিক পালাতে থাকল। কিন্তু নবী (স.) তাকে হাসতে হাসতে ধরে ফেলেন।
এরপর তিনি তাঁর এক হাত ছেলেটির চোয়ালের নিচে রাখলেন এবং অন্য হাত তার মাথার তালুতে রাখলেন। তিনি তাকে চুমু দিলেন এবং বলেন, ‘হোসাইন আমার থেকে এবং আমি হোসাইন থেকে। যে ব্যক্তি হোসাইনকে ভালোবাসে, আল্লাহ তাআলা তাকে ভালোবাসেন। হোসাইন আমার নাতিদের একজন।’ (ইবনে মাজাহ: ১৪৪)
অতএব, আমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাই, আমাদের অবশ্যই রাসুল (স.)-এর প্রতি পূর্ণ ভালোবাসা স্থাপন করতে হবে। তিনি যাদের ভালোবাসতেন তাদের ভালোবাসতে হবে। ইমাম হোসাইন ও হাসান (রা.)-কেও আল্লাহর জন্য ভালোবাসতে হবে। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সেই তাওফিক দিয়ে ভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমিন।