এখন পর্যন্ত সৌরজগতের প্রকাশিত সবগুলো ছবিতে কারসাজি করে মহাশূ্ন্যের অসীম বিশালতাকে ছেঁটে ফেলে দেয়া হয়েছে। নক্ষত্র, গ্রহ ও উপগ্রহকে যেনতেনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে গবেষণাপত্র, সংবাদমাধ্যম, পাঠ্যপুস্তকসহ সব কিছুতেই। মুদ্রিত হচ্ছে সৌরজগতের বানোয়াট আর অসত্য ছবি।
সেখানে গ্রহগুলোকে দেখানো হচ্ছে সূর্যের প্রায় সমান আকারের রঙিন বস্তু হিসেবে। সেই সঙ্গে মহাকাশের বাসিন্দাদের মধ্যকার অসীম দূরত্বকে কেটে-ছেঁটে পুরোপুরি উধাও করে দেয়া হচ্ছে। উপগ্রহগুলো এমনভাবে দেখানো হচ্ছে যেন সেগুলো কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট যা কিনা গ্রহের খুব কাছ দিয়ে প্রদক্ষিত হচ্ছে।
আসলে কেন এমনটি করা হচ্ছে? এমন গুরুতর ভুল সংশোধন করা কী সম্ভব? কী করে সবার সামনে প্রকাশ করা যেতে পারে সৌরজগতের যথার্থ ও বস্তুনিষ্ঠ ছবি।
ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আগে উত্তর জানিয়ে দিচ্ছি। মহাশূন্যের অসীম বিশালতার কারণে গ্রহ-নক্ষত্রসহ সৌরজগতের সঠিক ছবি বইয়ের পৃষ্ঠায় আনা সম্ভব হয়নি।
মহাশূন্যের বাসিন্দা গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যকার বিশাল দূরত্বকে সঠিক আনুপাতিকহারে কমিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠায় আনতে চাইলে এদের আকার হয়ে যেতে পারে বালু কণার মতো ক্ষুদ্র। বিশালাকার সূর্য যার ভর সৌরজগতের ৮৬ শতাংশ তা দেখা যেতে পারে বিন্দুর সমান।
সৌরজগত সম্পর্কে এমন প্রচলিত ভ্রান্তি দূর করতে সচেষ্ট হয়েছেন কেউ কেউ। তাদের কষ্টসাধ্য প্রকল্পগুলো থেকেই আমরা পেয়ে যাব ওপরের সেই সব প্রশ্নের জবাব।
কী বলে নাসা:
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার শিক্ষাবিষয়ক এক গবেষণায় দেখা যায়, সৌরজগতকে ফুটবল মাঠের সঙ্গে তুলনা করলে সূর্যকে দেখা যাবে গোলপোস্টের সামনে বসানো ১৭ মিলিমিটার ব্যাসের একটি ছোট মার্বেল বা পয়সার সমান। বৃহস্পতি, শনির মতো বিশালাকার গ্যাসীয় দানবগুলোতে দেখা যাবে শস্যদানা গম, ধানের সমান।
পৃথিবী আর মঙ্গলের মতো মাঝারি আকারের গ্রহকে দেখাবে সরিষা দানার সমান (ব্যাস ০.১৬ মি.মি)। শুক্রর মতো ছোটাকার গ্রহগুলো হয়ে যাবে আটা-ময়দার কণা বা সুঁইয়ের সূচালো অগ্রভাগের সমান (ব্যাস ০.০৬ মি.মি)।
১০০ মিটার লম্বা ফুটবল মাঠে সূর্য থেকে মাত্র দুই মিটার দূরত্বের মধ্যে থাকবে বুধ, ভেনাস ও পৃথিবী। মঙ্গলের অবস্থান হবে সূর্য থেকে চার মিটার দূরে। এর পরের দুই মিটার জুড়ে থাকবে অজস্র গ্রহাণুর বলয়। সাড়ে ১০ মিটার দূরে বৃহস্পতির অবস্থান। আর সূর্য থেকে শনিগ্রহের দূরত্ব হবে ১৯ মিটার।
সৌর কেন্দ্র থেকে প্রকাণ্ড গ্যাসীয় ইউরেনাস ৩৮ মিটার ও নেপচুন ৬০ মিটার দূরে। সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরের প্লুটোর ব্যবধানে হচ্ছে ৮০ মিটার।
দ্য ট্রু স্কেল অব দ্য ইউনিভার্স:
সৌরজগতসহ মহাবিশ্বের সঠিক আকার তুলনামূলকভাবে তুলে ধরা হয়েছে ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট আর্টিস্ট পিটার কাডমোরের সাড়া জাগানো প্রকল্প ‘দ্য ট্রু স্কেল অব দ্য ইউনিভার্সে’। সেখানে সৌরজগতের আকারকে ১৯ কোটি গুণ কমিয়ে আনার পর দেখা যায় পৃথিবী হচ্ছে একটি টেনিস বলের সমান। সূর্য হচ্ছে ২৪ ফুট ব্যাসের একটি প্রকাণ্ড গোলাকার গ্যাসীয় বস্তু।
পিটারের স্কেলে সৌরজগতে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী ও পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের আকার ধরা হয়েছে মার্বেলের সমান।
পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে নিজের অক্ষপথে প্রদক্ষিণ করছে চাঁদ। এমন ছবিই ভূ-গোল বইয়ে ছোটবেলা থেকে অনেকে দেখে দেখে অভ্যস্ত। তাদের অনেককে পিটার জিজ্ঞাসা করেছেন এদের মধ্যকার দূরত্ব হাত দিয়ে দেখাতে। সবাই কমিয়ে কমিয়ে দেখিয়েছেন। পরে সঠিক দূরত্বটি দেখালেন পিটার নিজেই। সেখানে দেখানো হয় এদের সঠিক দূরত্ব সাত ফুট। যা আমাদের প্রসারিত দুই হাতের চেয়েও বেশি।
এ মডেল অফ দ্য কসমস:
ব্রিটেনিকায় ‘এ মডেল অফ দ্য কসমস’ অধ্যায়ের লেখক টেরেন্স জ্যাকব জানিয়েছেন, পৃথিবীর আকার পিংপং বলের সমান হলে সূর্যের ব্যাস হবে ১৪ ফুট। বৃহস্পতির আকার হবে মাত্র বিচ বলের সমান (ব্যাস ১ ফুট/৩০ মি.মি)।
আর এদের দূরত্ব হবে ৪৬০ মিটার বা প্রায় আধা কিলোমিটার। এই স্কেলে মার্বেল আকৃতির চাঁদ থেকে পৃথিবীর দূরত্ব হবে চার ফুট।
সূর্য থেকে সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতির দূরত্ব আড়াই কিলোমিটার, শনির দূরত্ব সাড়ে চার কিলোমিটার আর নেপচুনের ১৪ কিলোমিটার।
ভূ-পৃষ্ঠে সৌরজগতের বাস্তব মডেল:
২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা অঙ্গরাজ্যের ব্ল্যাক রক ডেজার্টের সাত বর্গমাইল সমতল মরুতে এ সম্পর্কিত গবেষণার জন্য উপযুক্ত জায়গা হিসেবে বেছে নেন একদল গবেষক ও চলচ্চিত্র পরিচালক। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ওয়াইলাই ওভারস্ট্রিট ও অ্যালেক্স গোরস।
মহাশূন্যের বিশালতাকে সঠিকভাবে বজায় রাখার জন্য তারা মানবজাতির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এমন প্রকল্প হাতে নেন। গাড়ির পেছনে লোহার খননযন্ত্র বেঁধে তারা গ্রহগুলোর কক্ষপথ মরুর তপ্ত মাটিতে তৈরি করেন।
এই বিশাল প্রকল্পের মাঝে সূর্যের আকার একটি জলন্ত ফানুসের সমান। আর ১২ হাজার ৭৫৬ কিলোমিটার ব্যাসের এই পৃথিবী পেয়েছে ৫ মিলিমিটার ব্যাসের একটি মার্বেলের সমান আকার।
অসীম শূন্যতায় গ্রহ-নক্ষত্রের বিভ্রান্তিকর আকার:
উপরের এই চারটি প্রকল্প বা ভিন্ন স্কেল পর্যালোচনা করে সৌর বাসিন্দাদের আকার ও মহাশূন্যের অসীমতা সম্পর্ক সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
সত্যিকার অর্থে সূর্যের প্রকাণ্ড বিশালতার সঙ্গে তুলনা চলে না কোন গ্রহের আকারের। এমন কী বৃহস্পতিরও। সূর্য যদি একটি দ্বিতল বাসের সমান গোলাকৃতির গ্যাসীয় বস্তু হয় তবে বৃহস্পতি হতে পারে টেনিস বল আর পৃথিবী মার্বেলের সমান।
অন্যদিকে, মহাশূন্যের বিশাল শূন্যতার কাছে সৌরজগতের এমন সব বিশালাকার গ্রহগুলোর অস্তিত্বও প্রায় বিলীন হয়ে যায়। সূর্যও হারিয়ে ফেলে তার প্রকাণ্ড অবস্থান।
সাত বর্গমাইল বিস্তৃত এলাকায় যেমন একটি ফানুসকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। হোক না সেটা জ্বলন্ত। তেমনটি দুরূহ ব্যাপার হচ্ছে সেখানে টেনিস বল, মার্বেলের মতো বস্তুকে খোঁজা। আর ধান, গমের মতো শস্যদানাও পুরোপুরি অস্তিত্ব হারায় এমন বিশালতার কাছে।
সাত বর্গমাইলের সমান কাগজ বাদ দিন ধরুন কেউ যদি শুধু ফুটবল মাঠের সমান কাগজে সৌরজগতের সত্যিকারের ছবি শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করেন তবে তা দেখে কী তাদের মনে আদৌ কোন প্রভাব পড়বে।
উত্তর এক শব্দে বলা যায় ‘না’।
তাইতো সূর্যসহ এর চারদিকে প্রদক্ষিণরত গ্রহগুলোর রঙিন ছবিই বাস্তবে অনেক বেশি দাগ কাটতে পারে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মনে।
সৌরজগতের সত্যিকারের ছবি হয়তো তাদেরকে দেখানো সম্ভব হবে না। সেটা না হয় মেনে নেয়া যায় তবে কেন তাদেরকে এই না পারার পেছনের সত্যটা জানান হবে না সেটি কিন্তু মেনে নেয়া যায় না।
পিএসএন/এমঅাই