আবছায়া ঘরে মোমের আলো, সাথে সুগন্ধির সুবাস- এমন রোমান্টিক পরিবেশে কেউ যদি বলে- সুগন্ধি মোমবাতি শরীরের জন্য খারাপ! তখন হয়ত মেজাজটাই নষ্ট হয়ে যাবে।তবে আসল বিষয় হল, সুগন্ধিযুক্ত বা ছাড়া যে কোনো মোমবাতি বেশিক্ষণ জ্বললে শরীরে বাজে প্রভাব পড়তে পারে। তা সেটা যতই প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর লেখা থাকুক না কেনো!
সিএনএন ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, মোমবাতি জ্বালানোর পর রাসায়নিক বিক্রিয়ার বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।সাধারণ মোমবাতি তৈরি করার প্রধান উপাদান হল ‘প্যারাফিন’; যা প্রাথমিকভাবে পেট্রোলিয়াম পরিশোধনের পরে উপজাত হিসেবে তৈরি হয়।যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ক্যান্ডেল অ্যাসোসিয়েশন’য়ের তথ্যানুসারে- মোমবাতি তৈরির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় ‘প্যারাফিন’ ব্যবহার করা হয় সারা বিশ্বে।
‘ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক’য়ের সহকারী অধ্যাপক পালমোনোলজিস্ট ডা. সোবিয়া ফারুক এই বিষয়ে বলেন, “প্যারফিন’ আসলেই দেহে ক্ষতিকর প্রভাব রাখে, নাকি রাখে না- এই বিষয়ে জোরালো কোনো তথ্য নেই। তবে বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে ঝুঁকিটা থেকেই যায়।”
আর ক্ষতির বিষয়টা নির্ভর করে- কোনো পরিবেশে মোমবাতি জ্বালানো হচ্ছে, কতক্ষণ জ্বলছে, মোমবাতির মান কীরকম, যেখানে জ্বালানো হয়েছে সেখানকার বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা কী- ইত্যাদি বিষয়ের ওপর।
বিজ্ঞান যা বলে
প্যালাফিন’য়ের তৈরি মোমবাতি জ্বালানোর পর ‘ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ডস (ভিওসি)’ বা উদ্বায়ী জৈব যৌগ- যা এক ধরনের গ্যাস, বাতাসে নিঃসরিত হয়- প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করেন চীনের ‘কুনমিং মেডিকেল ইউনিভার্সিটি’ সংশ্লিষ্ট ‘ইয়ান হসপিটাল’য়ের গবেষক ডা. আরিফুল হক।
‘আমেরিকান লাং অ্যাসোসিয়েশন’য়ের তথ্যানুসারে এই যৌগ সাধারণত রং, পরিষ্কারক, প্রসাধনী, এয়ার ফ্রেশনার, গাড়ির ধোয়া, গ্যাসের চুলা জ্বলা-সহ নানান পন্থায় বাতাসে মিশ্রিত হয়।
কোনো কোনো ‘ভিওসি’ নিজেই ক্ষতিকর। কোনোটা আবার বাতাসে অন্যান্য গাসের সাথে মিশে বিক্রিয়া করে ক্ষতি করে।
মোববাতি থেকে প্রায় সময় যে ‘ভিওসি’ নির্গত হয়, সেটা হল ‘টলইউন’। এই স্বচ্ছ বর্ণহীন উদ্বায়ী তরলের রয়েছে স্বতন্ত্র গন্ধ। আর প্রাকৃতিকভাবে অপরিশোধি তেলে থাকে।
‘ইউএস এনভায়োরমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি’, ‘ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ এবং ‘অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেল্থ অ্যাডামিনিস্ট্রেইশন’সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ‘টলইউন’কে বিষাক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
কারণ এটা স্নায়ুতন্ত্র কেন্দ্রিক বিষাক্ততা তৈরি করে- মাথা ঝিমঝিম, মাথাব্যথাসহ দীর্ঘমেয়াদি নানান রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
‘বেনজিন’ নামক আরেকটি ‘ভিওসি’ নিঃসরিত হয় প্যারাফিন-যুক্ত মোমবাতি থেকে, যা ক্যান্সারজনক পদার্থ।
হক বলেন, “দীর্ঘসময় এই রাসায়নিকের সংস্পর্শে থাকলে রক্তে সমস্যা হতে পারে। যেমন- লিউকেমিয়া। নিঃশ্বাসের সাথে দেহে গেল ফুসফুস অস্বস্তি তৈরি করে।”
এছাড়া ‘পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বনস’ নিঃসরণ করে প্যারাফিন মোমবাতি। এটা ক্যান্সারজনক পদার্থ।
মাউন্ট সিনাই’য়ের ‘আইকান স্কুল অফ মেডিসিন’য়ের ‘এনভায়রনমেন্টাল মেডিসিন অ্যান্ড ক্লাইমেট সায়েন্স’য়ের সহকারী অধ্যাপক ডা. সারাহ ইভান্স বলেন, “বেশ অনেকগুলো গবেষণাই আছে, যেখানে বলা হয়ছে মোমবাতি জ্বালালে বাতাসের মান খারাপ হয়। আর সেই বাতাস নিঃশ্বাসের সাথে দেহের ভেতরে যাওয়ার কারণেণ ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।”
বর্তমানে সয়া মোম, মৌমাছির মোম এবং নারিকেল তেল বা প্রাণিজ চর্বি থেকে উৎপন্ন ‘স্টিয়ারিন’ থেকে মোমবাতি তৈরি করা হয়। ধরা হয়ে থাকে এগুলো স্বাস্থ্যকর।
তবে ইভানসস বলেন, “যে কোনো কিছু পুড়লে ক্ষতিকর অনু বা রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। তাই যে মোমবাতি-ই জ্বলুক ‘ভিওসি’ নির্গত হচ্ছে। শুধু প্যারাফিন মোম অন্যগুলোর চাইতে বেশি ক্ষতিকর।”
আর এই ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে যদি মোমবাতি হয় রঙিন বা সুগন্ধিযুক্ত। কারণ কৃত্রিম গন্ধও ‘ভিওসি’ নির্গত করে। এরমধ্যে আছে ‘ফ্যালেইটস’, যা শেখা ও আচরণগত সমস্যা, স্থূলতা, প্রজনন তন্ত্রের অসুবিধা-সহ নানান সমস্যা তৈরি করে- জানান ইভানস।
২০১৫ সালে একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি জানান, দেখা গেছে গন্ধযুক্ত মোমবাতির চেয়ে গন্ধহীন মোমবাতি কম দুষণ করে।
ঘরে সুগন্ধ তৈরির নিরাপদ উপায়
কোনো কোনো রাসায়নিক সাথে সাথে ক্ষতি করে, কোনটি আবার দীর্ঘমেয়াদে বাজে প্রভাব ফেলে। এই বিষয় গবেষণা যদিও কম হয়েছে।
তবে ডা. ইভান্স অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে, ঘরে মোমবাতি জ্বালানোর ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রাখার পরামর্শ দেন।
বিশেষ করে ঘরে যদি ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত কোনো রোগী, অ্যাজমার সমস্যা বা দীর্ঘমেয়াদী কোনো ফুসফুসের রোগ থাকে সেক্ষেত্রে মোমাবাতি জ্বালানোর ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেন তিনি।
“এমনকি সুগন্ধি এসেনশল অয়েল যুক্ত মোমবাতিও কারও কারও ক্ষেত্রে শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা তৈরি করতে পারে। চিন্তা ও বিবেচনায় বাধা ফেলতে পারে”- বলেন ডা. ইভান্স।
কোনো কোনো তেল শিশু ও পোষা প্রাণীর জন্য বিষাক্ত হতে পারে।
তাই মোমবাতি কেনা ও জ্বালানোতে বেশ কিছু বিষয় মাথার রাখার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ।
সম্ভব হলে একশতভাগ সয়া মোম, মৌমাছির মোম বা ‘স্টিয়ারিন ওয়াক্স’ দিয়ে তৈরি এমন মোমবাতি বেছে নিতে হবে।
সলতে যেন হয় সুতির সুতার, কাঠ বা সিনথেটিক।
যদি সুগন্ধি মোমবাতি পরিহার করতে না পারেন, তবে এসেনশল অয়েল বা ‘ফ্যালেইট’ (phthalate) মুক্ত লেখা কিনা দেখে কিনুন।
রঙিন মোমবাতি এড়াতে হবে।
ব্যবহার না হলে মোমবাতি ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
বাতাস চলাচল ভালো মতো করে এমন জায়গায় মোমবাতি জ্বালাতে হবে যাতে ‘ভিওসি’র কারণে বাতাসে দুষণ ঘরে আটকে না থাকে। কক্ষের আকার যত বড় হয় ততই মঙ্গল।
বাজে মোমবাতি কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে।
মোমবাতিতে বেশি ধোঁয়া হলে সলতে ছোট করে কেটে দিতে হবে। তাহলে ধোঁয়া কমবে।
মাথাব্যথা, শ্বাস প্রস্বাসে অস্বস্তি বা চোখের সমস্যা এড়াতে কম পরিমাণে সুগন্ধি মোমবাতি জ্বালাতে হবে।
শিশু, গর্ভবতী এবং ফুসফুস সংক্রান্ত রোগ আছে এমন কারও সামনে মোমবাতি জ্বালানো যাবে না।