সারগেসি শব্দের একেবারে সোজাসাপ্টা অর্থ হল গর্ভাশয় ভাড়া। একজন নারীর গর্ভে অন্য দম্পতির সন্তান ধারণের পদ্ধতিকে সারোগেসি বলে। আইভিএফ পদ্ধতিতে স্ত্রী ও পুরুষের ডিম্বাণু ও শুক্রাণু দেহের বাইরে নিষিক্ত করে তা নারীর গর্ভাশয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়।
অনেক চেষ্টার পরেও যখন সন্তান লাভের আর কোন আশা থাকে না তখনই কোনো দম্পতি সারোগেসির শরণাপন্ন হতে পারেন। সারোগেসির পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে কয়েকটি হল-
১) বারবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও গর্ভপাত হয়ে যাওয়া।
২) অসময়ে নারীর মেনোপজ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
৩) আইভিএফ চিকিৎসার মাধ্যমেও গর্ভধারণ না হওয়া।
৪) জরায়ুতে অস্বাভাবিকতা দেখা যাওয়া কিংবা কোন অস্ত্রোপচারের জন্য জরায়ু যদি বাদ পড়ে থাকে।
উপরোক্ত এই কারণ গুলির মধ্যে যেকোনো একটি কারণ দেখা দিলেই দম্পত্তির সারোগেসির শরণাপন্ন হতে পারেন।
এছাড়াও অনেক কারনেই মানুষ সারোগেট বেবি নিয়ে থাকেন, যেমন- সন্তান ধারনের কষ্ট সহ্য না করার ইচ্ছা, ব্যস্তাতার কারনে বা শারীরিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে, বিয়ে না করে সিংগেল ফাদার বা মাদার হওয়ার ইচ্ছা, ইত্যাদি নানা কারনে মানুষ সারোগেট বেবি নিয়ে থাকেন।
এধনের সারগেট বেবি নেওয়ার প্রবনতা ইন্ডিয়ায় কয়েক বছর আগেও ব্যপক জনপ্রিয় ছিল।
শাহরুখ খান, আমির খান তাদের একাধিক সন্তান থাকার পরেও সারোগেট বেবি নিয়েছেন, এদিকে আবার বিয়ে না করেই করণ জোহার, তুষার কাপুড়,একতা কাপুড় এবং আরো অনেকেই সারোগেট বেবি নিয়েছেন।
সারোগেসির প্রকারভেদঃ
সারোগেসি সাধারণত দুই রকমের হয়। একটি হচ্ছে পার্শিয়াল সারোগেসি এবং আরেকটি হচ্ছে ট্রু সারোগেসি।
১) পার্শিয়াল সারোগেসি অনেকদিন ধরেই চলে আসছে, সন্তানধারণে এখানে মা কোন ভূমিকাই পালন করেন না। বাবার শুক্রাণু আর সারোগেট মায়ের ডিম্বানু থেকে জন্ম হয় শিশুর।
২) ট্রু সারোগেসি তে মায়ের ডিম্বাণু এবং বাবার শুক্রাণু নিয়ে ল্যাবে ভ্রূণ তৈরি করা হয়। এরপর সেই এম্ব্রায়ো বা ভ্রূণ সারোগেট মায়ের ইউটিরেস বা জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। বর্তমানে সারোগেসির এই পদ্ধতিটি বেশিরভাগ দম্পতি গ্রহণ করেন।
পার্শিয়াল সারোগেসির ক্ষেত্রে সাধারণত সারোগেট মাদারের ডিম্বাণু এবং গর্ভ ভাড়া নেওয়া হয়। এর ফলে এই পদ্ধতিতে সারোগেসির ক্ষেত্রে সন্তানের ওপর সারোগেট মাদারের একটি জৈবিক অধিকার থেকেই যায়। তবে ট্রু সারোগেসি পদ্ধতি অবলম্বন করলে দম্পতির পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব নিয়ে কোনো সংশয় থাকে না। কারণ এই পদ্ধতিতে মায়ের শুক্রাণুর সাথে স্পার্ম ব্যাংকের অন্য পুরুষের শুক্রাণু কিম্বা বাবার শুক্রাণু অন্য মহিলার ডিম্বানুর সাথে নিষিক্ত করে ভ্রূণ তৈরি করা হয়।
তবে আইভিএফ পদ্ধতিতে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু নিষিক্ত করা কে টেস্টটিউববেবী মনে করা যায় না। টেস্টটিউব বেবি এবং সারোগেছি ভিন্ন পদ্ধতি।
কমার্শিয়াল সারোগেছি
বানিজ্যিক সারোগেছিতে একটা নিদৃষ্ট পরিমান অর্থের বিনিময়ে একজন মা তার নিজের গর্ভে অন্য একজনের সন্তান ধারন করেন। এ ক্ষেত্রে সারোগেট মাদার পান অর্থ এবং ইন্টেনডেড প্যারেন্টস্ পান সন্তান।
২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ভারত ছিল কমার্শিয়াল সারোগেছির হটস্পট, সারগেছি বিল ২০১৬ পাশ হবার পর বানিজ্যিক সারোগেছি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে তবে আলটুরিস্টিক সারোগেছি চালু আছে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বানিজ্যিক সারোগেছি প্রচলিত আছে, আবার অনেক দেশেই এটা অবৈধ।
সারোগেছির খরচ
ইন্ডিয়াতে একটা সারোগেট সন্তানের জন্য ১০ লাখ থেকে ৩০/৪০/৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়।
এই পর্যন্ত আলোচনায় আমারা সারোগেছি সম্পর্কে একটা ধারণা পেলাম এবার আমরা দেখব বিভিন্ন দেশে সারোগেছি সংক্রান্ত আইন কানুন নিয়ে-
আপনারা স্ক্রিনে দেখতে পাচ্ছেন কোন কোন দেশের আইনে সারোগাছি লিগ্যাল, কোন কোন দেশে ইলিগ্যাল। এবং এটাও দেখতে পাচ্ছেন কোন কোন দেশে বানিজ্যিক সারোগেছির লিগ্যাল বা ইলিগ্যাল।
ইসলামিক আইনে সারোগেছি
ইসলামিক আইনে টেস্টটিউব বেবি হালাল হলেও, সারগেছি হারাম।
ইসলামী স্কলারদের মতে, এই জাতীয় সারোগেট মাতৃত্বের অনুমতি নেই কারণ এটি জিনা (ব্যভিচার) এর সমতুল্য, যেহেতু সারোগেট তার বৈধ স্বামী নয় এমন ব্যক্তির নিষিক্ত ডিম বহন করে। যে সন্তানের জন্ম হয়, বৈধ বিবাহের মাধ্যমে তার কোন বংশগত সম্পর্ক নেই, এই কারনে সন্তানটি অবৈধ বলে গন্য হবে। যেহেতু সন্তানটি অবৈধ, সেহেতু এই পদ্ধতি অর্থ্যাৎ সারোগেছি কে হারাম বলা হয়েছে।
১১ থেকে ১৬ ই অক্টোবর ১৯৮৬ সালে, জর্ডানের রাজধানী আম্মানে ইসলামিক ফিকহ একাডেমি কাউন্সিলের তৃতীয় অধিবেশনে ঘোষনা করা হয় যে, সারোগেছি ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশে সারোগেছি
বাংলাদেশ একটি মুসলিম মেজরিটি কান্ট্রি হওয়ায় এখানে টেস্টটিউব বেবি আইনগত ভাবে বৈধ হলেও, সারোগেছির বিষয়টি এখনও আইনগত ভাবে বৈধতা পায় নি।
কিন্তু জার্মানভিত্তিকসংবাদপত্র ডয়েচেভেলের বরাত দিয়ে জানা যায় বাংলাদেশে গোপনে গোপনে সারগেছি চলে বলে ধারণা করা হয়।
বাংলাদেশে নিঃসন্তান দম্পতির সংখ্যা শতকরা ১৫ ভাগ বলে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয়, যদিও এ ব্যাপারে কোন সঠিক জরিপ নেই।
ফাইন্ড সারোগেট মাদার নামক এই ওয়েব সাইটে দেখা যাচ্ছে অনেক বাংলাদেশিই সারগেট হওয়ার জন্য, আবার অনেকে সারোগেট ভাড়া নেওয়ার জন্য এড দিয়ে রেখেছেন।
আবার Elawoman নামক একটি ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের- ঢাকায় দুইটি এবং চিটাগং এ একটি প্রাইভেট হসপিটাল সারোগেছি সেন্টার হিসাবে লিস্টেড রয়েছে। এদের মধ্যে একটি ১০ লাখ, একটি ১৪ লাখ এবং একটি ১৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা সারোগেছি কষ্ট দিয়ে রেখেছে। আমার ধারণা এরা সারোগেছি ক্লাইন্ট ইন্ডিয়ায় ফরোয়ার্ড করে থাকে। Ela woman এর ইউটিউব চ্যানেলে একটা ইন্টারভিউ আছে যেখানে দেখা যাচ্ছে একজন নারি, বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিয়ায় গিয়ে সারোগেছি করানোর অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন।
সারোগেছি নিয়ে মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মতভেদ লক্ষনীয়, একাংশের মতে, নিম্নবিত্ত কোনো মহিলা যদি অর্থের বিনিময়ে নিজের গর্ভ স্বেচ্ছায় ভাড়া দেন, তাহলে আপত্তি কেন হবে? যদি ডাক্তাররা তাঁর দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উপযুক্ত বলে মনে করেন৷ কিডনি বেচার কিংবা পতিতাবৃত্তি করার চেয়ে এটা কি ভালো নয়? আবার অন্যদিকে বাণিজ্যিক সারোগেসির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে নারীবাদীদের অন্য অংশে বলেন, ভারতে সারোগেসি ক্লিনিকগুলি ধনীদের জন্য নিছক ‘বেবি-ফ্যাক্টরি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইন না থাকায় শেষ মুহূর্তের শিকার হচ্ছে গরিব ও অশিক্ষিত মহিলারা।
পিএসএন/এমআই