শূন্য পদে জনবল নিয়োগে সরকারের প্রয়োজনীয় দক্ষতা এখনো গড়ে ওঠেনি। এ ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনাও নেই। এ কারণে সরকারি চাকরির অন্তত ৭৭ শতাংশ পদে অদক্ষ ও অযোগ্য লোকজন চাকরি পাচ্ছেন। স্বজনপ্রীতি, ঘুষ ও অবশিষ্ট কোটা পদ্ধতি এ ক্ষেত্রে নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির প্রার্থী বাছাই করে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। এ ক্ষেত্রে তাদের ব্যাপক দক্ষতা গড়ে উঠলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির প্রার্থী বাছাইয়ে সরকারের প্রয়োজনীয় দক্ষতা গড়ে ওঠেনি।
পিএসসির বাইরে শূন্য পদে জনবল নিয়োগে কেন দক্ষতা গড়ে ওঠেনি জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘স্বজনপ্রীতি করার জন্য। গড়পড়তা ৩০ বছরের চাকরি জীবনে প্রায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারী চান তার একজন স্বজন চাকরি পাক। এখানে ঘুষও বড় নিয়ামক।’ তিনি বলেন, ‘নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দক্ষতা গড়ে উঠলে অনিয়ম করার বা সোজা কথায় ঘুষ নেওয়ার সুযোগ কমে যাবে। কে চায় নিজের সুযোগ কমাতে? যারা চায় তারা সংখ্যায় এতটাই কম যে, তারা নিজেদের ক্ষমতা দিয়ে তা প্রতিরোধ করতে পারেন না। আর যারা অনিয়ম লালন করতে চায় তারা এতটাই সংঘবদ্ধ যে, তারা মিলেমিশে ভাগবাটোয়ারা করে লুটেপুটে খায়। এটা একটা চক্র। এই চক্রের একজন একবার সুযোগ না পেলে পরেরবার পায়। এভাবে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তর, করপোরেশন, মাঠপর্যায়ের বিভাগ, জেলা ও উপজেলার সব সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জনবলের তথ্য ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস, ২০২০’ প্রকাশ করেছে গত বছর ১৫ জুন। এতে বলা হয়েছে, সরকারে কর্মচারী আছেন মোট ১৫ লাখ ৪ হাজার ৯১৩ জন। প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা ১ লাখ ৮৪ হাজার ২২৯ জন। যা মোট কর্মচারীর ১২ শতাংশ। দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারী ১ লাখ ৭০ হাজার ৭৬৬ জন, যা মোট সংখ্যার ১১ শতাংশ। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ৮ লাখ ৯৫ হাজার ৩১৭ জন, যা মোট জনবলের ৬০ শতাংশ। চতুর্থ শ্রেণির পদে কর্মরত আছেন ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬০১ জন যা মোট কর্মচারীর ১৭ শতাংশ।
সরকারের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির জনবল নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি, যা মোট পদের ২৩ শতাংশ। তবে এসব পদের একটা বড় অংশ পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ হয় না। সংশ্লিষ্ট দপ্তর-অধিদপ্তর মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এসব নিয়োগ দিয়ে থাকে। পিএসসির নিয়োগ প্রক্রিয়া একসময় দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়লেও গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর থেকে তা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ড. সা’দত হুসাইন যখন চেয়ারম্যান ছিলেন তখন তার কঠোর ব্যবস্থাপনায় পিএসসি সেই কালিমা থেকে বের হয়ে এসেছে। এরপর থেকে দৃশ্যত কোনো অনিয়মের কথা জানা যাচ্ছে না।
জনপ্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রেণির আর কয়টা পদ। সবই তো তৃতীয় আর চতুর্থ শ্রেণির। বিশেষ করে তৃতীয় শ্রেণির পদই বেশি। এসব পদে নিয়োগেই যত অনিয়ম হয়। শূন্য পদের কারণে দপ্তরের কাজে সমস্যা হলেও অনেক সচিব নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে চান না। কারণ অনেক সময় শূন্য পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে চাপ দেওয়া হয়। দলীয় নেতাকর্মীদের চাকরি দিতে বাধ্য করা হয়। দলীয় কর্মীদের কথা বলা হলেও আসলে এগুলোর বেশিরভাগই দলীয় লোক নয়। দলীয় কর্মীদের কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়া যায় না। দলের বাইরের লোকদের চাকরি পাইয়ে দিলে মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়া যায়। আর এসব কিছুর দায় নিতে হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবকে। এ কারণে বেশিরভাগ সচিব নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকতে চান।
জনপ্রশাসনের ওই কর্মকর্তা বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ার জটিলতা থেকে অনেক মন্ত্রণালয়ের সচিব দূরে থাকেন বলে বিভিন্ন দপ্তরে শূন্য পদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, দপ্তরের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়।
জনবলের অভাবে তদারকি কাজ উপেক্ষিত হওয়ার কারণে এ সমস্যা শুধু শ্রম মন্ত্রণালয়েই নয়, অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের দপ্তর-অধিদপ্তরেও হরহামেশাই ঘটছে। সম্প্রতি জনবল ঘাটতির কথা জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (রাজউক) তাদের স্বাভাবিক তদারকি করতে পারে না জনবলের অভাবের জন্য।
জনপ্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কর্মচারী পদের একটা বড় অংশ থাকে শূন্য। গত ১০ বছরে এ ধরনের পদের সংখ্যা আড়াই লাখের নিচে নামেনি। এসব পদে নিয়োগ করতে সরকারের উদ্যোগ খুবই সামান্য। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার ১৪ হাজার ৫৫৩ জনকে নিয়োগ দিতে পেরেছে। তার আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৪৮ হাজার ৮৮৭। সব মিলিয়ে এক বছরে সরকার ৫০ হাজারের বেশি পদে নিয়োগ দিতে পারে না। করোনা মহামারীর জন্য গত বছর নিয়োগ প্রক্রিয়া শ্লথ হয়ে যায়। সেই অবস্থা কাটিয়ে এ বছরের শুরুতেই চাকরির বাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। প্রতি শুক্র ও শনিবার একাধিক সংস্থার চাকরির পরীক্ষা থাকে। অনেক সংস্থা চাকরির পরীক্ষা নেওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও ত্রুটি রয়েছে। ১৬ থেকে ২০ গ্রেডের চাকরির পরীক্ষার ধরন নির্ধারণ করে নিয়োগ কমিটি। একেক সংস্থায় নিয়োগের জন্য একেক পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়। এতে অনিয়ম করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাছাড়া বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসহ (বিসিএস) বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ক্ষেত্রে মৌখিক পরীক্ষায় নম্বর অস্বাভাবিক রকম বেশি। এ পরীক্ষায় বেশি নম্বর বরাদ্দ রাখলে অনিয়মের বড় সুযোগ তৈরি হয়। বিসিএসে এখন মৌখিকের নম্বর ২০০। অথচ একসময় এ নম্বর ছিল ১০০। বিসিএসের মতো বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তাদের দপ্তরের পরীক্ষায়ও বেশি নম্বর মৌখিকের জন্য বরাদ্দ রাখে। এতে অনিয়মের দুয়ার খুলে যায়। এছাড়া কোটা পদ্ধতিও যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি থেকে মুক্তিযুদ্ধ কোটা তুলে দিলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে পুরো কোটা পদ্ধতি বিদ্যমান রয়েছে। এ দুই শ্রেণির চাকরিতে মেধাবীদের কোনো কোটা নেই। মুক্তিযুদ্ধ, জেলা, নারী, আনসার-ভিডিপি কোটা দিয়ে শতভাগ নিয়োগ দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম থেকে বের হয়ে আসার জন্য সরকার একটা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এ ক্ষেত্রে বেশি অগ্রগতি হয়নি। বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল বিভিন্ন পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যখন সরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি পরীক্ষা ব্যাপকভাবে নেওয়ার কাজ শুরু করে। বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসব নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সরকারি সংস্থা নিয়োগ পরীক্ষা নিলে যে ব্যয় হয় তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরীক্ষাগুলো নেওয়া শুরু করলে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ প্রক্রিয়া বন্ধ করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুক্তি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে লেখাপড়া করানো, সরকারি দপ্তরের পরীক্ষা নেওয়া নয়। এরপরই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পিএসসিকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির মতো তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করে। কিন্তু পিএসসি জানায়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরির প্রার্থী বাছাই করতে হলে তাদের কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে, যা সময়সাপেক্ষ। এরপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে আর এগোয়নি।
পিএস/এনআই