আরও একবার জিতে যাচ্ছে ফুটবল, জিতে যাচ্ছেন ফুটবল সমর্থকরা। রোববার রাতে ফুটবল বিশ্বে যে কালবৈশাখী ঝড় উঠেছিল, ৪৮ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই খেই হারালো সেটা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ৬টি ক্লাব এক এক করে ‘বিদ্রোহী লিগে’ অংশগ্রহণ থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়ার পরই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল সুপার লিগের সম্ভাবনা।
এবার ইংল্যান্ডের এই ৬ ক্লাবের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরও দুটি ক্লাব। ইতালির ইন্টার মিলান এবং স্পেনের অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। মোট ১২ ক্লাবের মধ্যে আটটি ক্লাবই নিজেদেরকে সরিয়ে নিয়েছে সুপার লিগের পরিকল্পনা থেকে। বাকি থাকলো আর চারটি। আয়োজক রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস, বার্সেলোনা এবং এসি মিলান।
জুভেন্তাস প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেয়া আগ্নেলি এবং রিয়াল মাদ্রিদ প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের মস্তিষ্কপ্রসূত ইউরোপিয়ান সুপার লিগের পরিকল্পনা। উয়েফা এবং ফিফার বহিষ্কারের হুমকির মুখেও অকুতোভয় পেরেজের হার না মানা মনোভাব ব্যুমেরাং হয়ে ফিরল মঙ্গলের রাতেই।
উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে বেরিয়ে এসে বিদ্রোহী লিগের পরিকল্পনায় প্রাথমিকভাবে যে ১২টি ক্লাব নাম লিখেছিল, মঙ্গলবার এর মধ্য থেকে ইংল্যান্ডের ৬টি ক্লাবই পিছু হটার প্রস্তুতি শুরু করে দেয়।
ফ্রান্সের প্যারিস সেন্ট জার্মেই (পিএসজি) আগেই ঘোষণা দেয়, তারা সুপার লিগে যোগ দেবে না। একইভাবে জার্মানির বরুশিয়া ডর্টমুন্ড প্রথমে ঘোষণা দেয় যোগ না দেয়ার। এরপর তাদের পথে হাঁটে বায়ার্ন মিউনিখও। তারাও ঘোষণা দেয় সুপার লিগে যোগ দেবে না।
সোমবার এবং মঙ্গলবার দিনভর সুপার লিগের পরিকল্পনাকে ধিক্কার জানিয়ে ফুটবল সমর্থকদের প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। যা আছড়ে পড়েছিল ইংল্যান্ডের বিভিন্ন প্রান্তে। কেবল সমর্থকেরাই নন, তলে তলে এমন পরিকল্পনার বিরোধীতায় সুর চড়াচ্ছিলেন কোচ থেকে ফুটবলাররাও।
নিজেদের সরিয়ে নেয়ার পর ইংলিশ ক্লাব আর্সেনাল থেকে ক্ষমাও চাওয়া হয়। তারা লিখেছে, ‘আমরা ভুল করেছি, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’
প্রিমিয়ার লিগ বর্তমান চ্যাম্পিয়ন লিভারপুলের অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসন মঙ্গলবার এক ভার্চুয়াল মিটিংয়ের আয়োজন করেছিলেন ইংল্যান্ডের অন্য পাঁচ ক্লাবের অধিনায়কের সঙ্গে, যারা প্রাথমিকভাবে সুপার লিগে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
সেই মিটিংয়ের পর লিভারপুল ফুটবলারদের মাইক্রোব্লগিং সাইট ভরে ওঠে এক বিশেষ বার্তায়। সমর্থকদের আবেগকে সর্বার আগে প্রাধান্য দিয়ে অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসনসহ ভার্জিল ফন ডাইক, অ্যান্ডি রবার্টসন, জেমস মিলনাররা টুইট বার্তায় লেখেন, ‘সুপার লিগ আমাদের পছন্দ নয়, আমরা চাই না এটা বাস্তবে হোক। আমরা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে সেটা আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। এই ফুটবল ক্লাব এবং সমর্থকদের প্রতি আমরা চরম এবং নিঃশর্তভাবে দায়বদ্ধ।’
এরপরেই একেএকে শুরু হয় সুপার লিগ থেকে বেরিয়ে আসার পালা। সর্বপ্রথম এক বিবৃতিতে ম্যানচেস্টার সিটি সুপার লিগের পরিকল্পনা থেকে সরে আসার কথা জানিয়ে লেখে, ‘ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাব নিশ্চিত করছে যে ইউরোপিয়ান সুপার লিগের প্রস্তাবিত প্রজেক্ট থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেছে।’
এরপর লিভারপুল জানায়, ‘ইউরোপিয়ান সুপার লিগের প্রস্তাবিত প্রজেক্টে তারা আর নেই।’ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড জানায়, ‘আমরা আমাদের সমর্থক, যুক্তরাজ্য সরকার এবং স্টেকহোল্ডারদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা অন্যদের সঙ্গে একই ছাদের নিচে থাকতে চাই এবং ফুটবলের জন্য যে সকল দীর্ঘমেয়াদী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলোর নিষ্পত্তি করতে চাই।’
আর্সেনাল এবং টটেনহ্যাম এক বিবৃতিতে উয়েফার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে পুরো ঘটনার জন্য। ইউরোপিয়ান ফুটবলের গভর্নিং বডিও সাদরে ফের কাছে টেনে নিয়েছে ক্লাবগুলোকে।
উয়েফা প্রধান আলেকসান্দার সেফেরিন বলেন, ‘আমি আনন্দিত ইংল্যান্ডের ক্লাবগুলো সরে দাঁড়ানোয়।’
সুপার লিগের বিরোধিতা করার জন্য সমর্থকদেরও অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি। স্পেনের বাণিজ্যিক আদালত যদিও সুপার লিগ আয়োজনে বাধা না দেওয়ার জন্য আবেদন করেছে ফিফা এবং উয়েফার কাছে। তবে ৮টি ক্লাব সরে আসায় সুপার লিগ আদৌ হবে কি না সে বিষয়টিই এখন পড়ে গেলো পুরোপুরি ধোঁয়াষার মধ্যে।
সোমবার প্রিমিয়ার লিগে লিডসের বিরুদ্ধে ম্যাচ শুরুর আগে সুপার লিগ ঘিরে লিভারপুল সমর্থকদের যে আন্দোলন এবং বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, মঙ্গলবার ব্রাইটনের বিরুদ্ধে মাঠে নামার আগে চেলসি সমর্থকদের সেই বিক্ষোভ মারাত্মক আকার ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত সেই ক্ষোভের কাছে সুপার লিগের পরিকল্পনায় মাথা নোয়ানোয় খুশি সাবেক তারকারাও।
সাবেক ম্যানইউ তারকা গ্যারি নেভিল সুপার লিগের পরিকল্পনা হোঁচট খাওয়ায় বিয়ার হাতে সেলিব্রেশনের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন। লিভারপুলের সাবেক জেমস ক্যারাগার যেমন একটি এপিটাফের ছবি মজার ছলে পোস্ট করেছেন। সেখানে লেখা, ‘সুপার লিগের জন্ম : ৮ এপ্রিল, ২০২১ এবং মৃত্যু: ২০ এপ্রিল, ২০২১।’