সবজির বাজারে যেন লাগাম দেওয়ার কেউ নেই। নতুন করে কয়েকটির দাম আরও বেড়েছে। ফলে হাতেগোনা তিন-চারটি ছাড়া বেশির ভাগ সবজির দর শতক ছাড়িয়েছে। শুধু শহর নয়, উৎপাদন এলাকায়ও চড়া দাম শাকসবজির। ফলে সীমিত আয়ের মানুষের কাছে সবজিও হয়ে উঠেছে অনেকটা বিলাসী পণ্য। তবে চিনি, ডিম ও গরুর মাংসের দাম কিছুটা কমতির দিকে। আবার আগের মতোই উচ্চ দরে স্থির রয়েছে চাল, ডাল, তেলসহ কয়েকটি নিত্যপণ্য। তাতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের পরিবারগুলোকে।
সবজির দর বাড়ার পেছনে নানা কারণ তুলে ধরছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা, কৃষক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তারা জানিয়েছেন, এ বছর অসময়ে টানা বৃষ্টিতে সবজির চারা ও ফুল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় উৎপাদন কমেছে। পাশাপাশি আগাম শীতকালীন সবজি চাষ করার জন্য অন্য বছরের তুলনায় এবার অধিক পরিমাণ জমি পতিত রাখা হয়েছে। এটিও উৎপাদন কম হওয়ার অন্যতম কারণ।
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর বাজারে সব ধরনের সবজির দর তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছিল। স্বস্তিদায়ক সেই পরিস্থিতি মাসখানেকের মতো ছিল। এর পর থেকেই পুরোনো চেহারায় ফিরেছে সবজির বাজার।
সরকারের সংশ্লিষ্টদের দাবি, দাম বাড়ার মূল কারণ টানা বৃষ্টি। তবে প্রতিদিনই বাজার তদারকি হচ্ছে। আমদানির অনুমতি, শুল্ক কমানোসহ কিছু ইতিবাচক উদ্যোগে ইতোমধ্যে কয়েকটি পণ্যের দর কমতে শুরু করেছে।
ঢাকায় অনেক সবজির সেঞ্চুরি
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা কারওয়ান বাজার, মহাখালী ও বনানী কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, ১০০ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে চারটি সবজি। এর মধ্যে প্রতি কেজি ঢ্যাঁড়শ ৮০-৯০, পটোল ৬০-৮০, পেঁপে ৫০-৬০ ও মুলা ৭০-৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ সবজির দাম ১০০ টাকার ওপরে। যেমন– বরবটির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০-১৪০ টাকা দরে। গোল বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৬০ টাকা দরে। মাসখানেক আগে বরবটি ও গোল বেগুনের কেজি কেনা গেছে যথাক্রমে– ৬০ ও ৭০ টাকার আশপাশের দরে। এক মাস আগে কাঁকরোল ও উচ্ছের কেজি ছিল ৬০ থেকে ৭০ টাকা। সবজি দুটি কিনতে ক্রেতাকে এখন গুনতে হচ্ছে অন্তত ১০০-১২০ টাকা। ঝিঙা ও ধুন্দলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকা দরে। দুই সপ্তাহ আগেও সবজি দুটি কেনা গেছে ৭০ টাকার আশপাশের দরে।
তবে কাঁচামরিচের বাজারে অস্থিরতা চলছেই। কারওয়ান বাজারের মতো পাইকারি বাজারে কাঁচামরিচের কেজি ৩০০-৩২০ টাকায় বিক্রি হলেও বনানী কাঁচাবাজারে বিক্রি হয়েছে ২৮০-৩০০ টাকা দরে। তিন দিন আগে কাঁচামরিচের কেজি ছিল ২০০-২৪০ টাকা।
কী বলছেন আড়তদাররা
বাংলাদেশ পাইকারি কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান মাস্টার সমকালকে বলেন, এ বছর ঘন ঘন বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও বৃষ্টির পরিমাণ অস্বাভাবিক। তাতে সবজি ক্ষেত ডুবে গেছে। উঁচু এলাকায় না ডুবলেও গাছের গোড়ায় পানি জমে গাছ পচে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বছরের এ সময় শীতের কিছু সবজি আগাম বাজারে আসে। যেমন– ফুলকপি, বাঁধাকপি ও শিম। এসব সবজি উত্তরবঙ্গ, নোয়াখালী, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া ও খুলনা অঞ্চলে বেশি হয়। কিন্তু সেসব এলাকায় পানির কারণে বীজ লাগানো যাচ্ছে না। সার্বিকভাবে সবজির সরবরাহ কমছে। তাছাড়া এ সময় শ্রমিকদের মজুরিও বেশি দিতে হয়। সেজন্য উৎপাদন এলাকায় কৃষকরাও এখন তুলনামূলক দাম বেশি নিচ্ছেন।
উৎপাদন এলাকায় তিন গুণ বেড়েছে
তাঁর কথার অনেকটা মিল পাওয়া গেছে উত্তরাঞ্চলের উৎপাদন এলাকা বগুড়া ও গাইবান্ধার বাজারে। গতকাল বগুড়ার বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, পটোলের কেজি ৮০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৩০-৪০ টাকা। এভাবে প্রতি কেজি কাঁকরোল ৭৫-৮০, বেগুন ৯০-৯৫, মিষ্টিকুমড়া ৫০-৫৫, কচুরমুখি ৬৫-৭০, মুলা ৫৫-৬০ এবং ৩৫-৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগে এসব সবজির কেজি ছিল যথাক্রমে– কাঁকরোল ৪০, বেগুন ৬০, মিষ্টিকুমড়া ৩০, পেঁপে ২০, কচুরমুখি ৪০ টাকার আশপাশের দরে। এক সপ্তাহ আগের ১৬০ টাকার কাঁচামরিচের কেজি এখন ৩৬০ টাকা।
একইভাবে গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর সবজিখ্যাত হিসেবে পরিচিত। সেখানে দামও থাকত কম। কয়েক দিন ধরে সেখানে কোনো কোনো সবজির দাম তিন গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। গতকাল ওই এলাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি আলু ৬০-৬৫ টাকা, বেগুন ৭০-৮০, পটোল ৫৫-৬০, করলা ১১০-১২০, বরবটি ১১০-১২০, ঝিঙা ৫৫-৬০, মুলা ৪৫-৫০, শসা ৭০-৮০, কাঁকরোল ৭০-৮০, ঢ্যাঁড়শ ৫৫-৬০, মিষ্টিকুমড়া ৫৫-৬০, পেঁপে ২৫-৩০, কাঁচামরিচ ২৬০-২৮০ টাকা এবং লাউ প্রতি পিস ৪৫-৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
কমেছে সরবরাহ
বগুড়ার মহাস্থানহাটের পাইকাররা ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় প্রতিদিন ২৫-৩০ ট্রাক সবজি নিয়ে গেলেও উৎপাদন কম থাকায় এখন পাঁচ-ছয় ট্রাকের বেশি নিতে পারেন না। এখানকার পাইকারি ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি প্রতিদিন কমপক্ষে তিন ট্রাক সবজি নিয়ে যান ঢাকা কারওয়ান বাজারে। এখন মাত্র এক ট্রাক নিচ্ছেন। বগুড়া সদরের শেখেরকোলা এলাকার সবজি চাষি আফজাল হোসেন বলেন, তিনি পটোল ও বেগুন চাষাবাদ করেন দুই বিঘা জমিতে। লাগাতার বৃষ্টিতে সবজি গাছের ফুল পচে গেছে, তাতে উৎপাদন কমে গেছে। এখন যা উৎপাদন হচ্ছে, তা দিয়ে খরচ উঠছে না।
তবে আমদানির উদ্যোগ ও শুল্ক কমানোর খবরে গত তিন দিনে ডিমের ডজনে ২০ টাকার মতো কমে বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায়। যদিও পাড়া-মহল্লায় কোনো কোনো ব্যবসায়ী এর চেয়েও বেশি দর নিচ্ছেন। ব্রয়লার মুরগির দর কমেনি। এখনও ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮০-২০০ টাকা দরে। তবে অপরিবর্তিত সোনালি জাতের মুরগি। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায়। মাস দেড়েক আগে ডিমের ডজন ১৪০ থেকে ১৪৫ এবং ব্রয়লারের কেজি ছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। কারওয়ান বাজারের ডিম ব্যবসায়ী সাইফুল গাজী বলেন, তিন-চার দিন ধরে পাইকারিতে একটু একটু করে কমছে। এজন্য খুচরা বাজারে কমছে দর।
তবে স্বস্তির খবর আছে গরুর মাংসের বাজারে। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭৩০ টাকা দরে। দুই মাস আগে মাংসের কেজি ৭৫০ টাকার বেশি ছিল।
দুই মাসের বেশি সময় ধরে চালের বাজার বাড়তি। বিআর-২৮ ও পায়জাম জাতের বা মাঝারি আকারের চালের কেজি খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬৪ টাকায়। মোটা চালের (গুটি স্বর্ণা ও চায়না ইরি) কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। এ ছাড়া চিকন চাল (মিনিকেট) বিক্রি হচ্ছে কেজি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে। দুই মাস আগে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫০, মাঝারি চাল ৫৪ থেকে ৫৮ এবং চিকন চাল ৬৮ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
সম্প্রতি ভারত চাল রপ্তানিতে শর্ত শিথিল করেছে। শুল্ক কমানোর সুপারিশও করেছে ট্যারিফ কমিশন। যদিও শুল্ক এখনও কমানো হয়নি। আমদানির খবরও পাওয়া যায়নি। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি হলে দর কমে যাবে।
তবে শুল্ক কমানোর কারণে চিনির কেজিতে তিন টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ১২৫-১৩৫ টাকায়। কিছুটা কমতির দিকে রয়েছে ভোজ্যতেলের দরও।
রপ্তানির শর্ত শিথিল করায় ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা শুরু হয়েছে। কিন্তু দর কমেনি। বরং বেড়েছে কিছুটা। এখনও দেশি পেঁয়াজের কেজি ১১৫ থেকে ১২০ এবং ভারতীয় পেঁয়াজের কেজি ১০০ থেকে ১১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
নিত্যপণ্যের এমন আগুন দরে দুর্ভোগে পড়েছেন ভোক্তারা। গতকাল বনানী কাঁচাবাজারে বেসরকারি চাকরিজীবী মনিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, নতুন সরকারের কাছে মানুষ যে আশা করেছিল, তা দেখা যাচ্ছে না। এমন কোনো জিনিসি নেই, যার দর বাড়েনি। মানুষের এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। জিনিসপত্রের দর না কমলে এ সরকারের বিরুদ্ধেও মানুষ রাস্তায় নামবে।
কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা
বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মুজাহিদ সরকার বলেন, বর্ষাকালে বৃষ্টি কম হলেও হঠাৎ আশ্বিন মাসে অসময়ে লাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে সবজির ফুল পচে যাচ্ছে। এ ছাড়া কৃষকরা আগাম শীতকালীন সবজি চাষ করার জন্য অনেক জমি পতিত রাখায় উৎপাদন কমেছে।
জেলা কৃষি বিভাগের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) নাজমুল হক মণ্ডল বলেন, শাকসবজির দাম বাড়লেও আগামী এক সপ্তাহ পর থেকে শীতকালীন সবজি বাজারে উঠতে শুরু করলে সবজির দাম কমে আসবে।
সাদুল্লাপুরের অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম বসুনিয়া বলেন, এই সময়ে এমনিতে সবজি উৎপাদন কম হয়। তার মধ্যে কয়েক দিনের টানা বর্ষণে সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। সেজন্য সব সবজির দাম বেড়েছে।
দাম নাগালে রাখতে গতকালও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিদপ্তরের একাধিক টিম বাজার তদারকি করে। গতকাল বনানী কাঁচাবাজার পরিদর্শনে গিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সুলতানা আক্তার ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, পণ্যের ক্রয় রসিদ রাখতে হবে। অযৌক্তিক দরে বিক্রি করলে জরিমানা করা হবে। এ সময় তিনি বলেন, গত কয়েক দিনের তুলনায় ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর দাম কিছুটা কমেছে। আরও কমে আসবে।
গতকাল সারাদেশে নিত্যপণ্যের বাজারে অভিযান চালিয়ে ভোক্তা অধিদপ্তর ৩৯টি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন অপরাধের দায়ে ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা জরিমানা করেছে।