একটি সভ্য রাষ্ট্রের পূর্বশর্ত নিরাপত্তা। নিরাপত্তাহীন সমাজ ব্যবস্থা কার্যত বসবাস অযোগ্য একটি সমাজ ব্যবস্থা। মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম দুটি। একটি সত্য-সুন্দর, উত্তম-ভালো, আলোকিত পথ। আরেকটি ঠিক তার বিপরীত। অসত্য-অসুন্দর, অন্ধকার পথে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংগঠন মানুষের আরেকটি ধর্ম। মানুষ যেমন ভালো হতে চায়, এটি তার প্রকৃতিগত একটি বৈশিষ্ট্য, তেমনি মানুষ খারাপ হতেও চায়, এটিও তার ভেতরকার খারাপ বা অসত্যের একটি সত্ত্বা। এই ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। ভালো মানুষ গড়তে হলে, অর্থাৎ মানুষের ভেতরে আলোকিত বোধ জাগাতে হলে তথা সত্যের পথে আনতে হলে প্রয়োজন বিবেকের সংবিধান রচনা। সুন্দর ও বিবেক বিবর্জিত মানুষই মূলত পশুর নামান্তর। বর্বরতা আর পাশবিকতা সমর্থক। যেহেতু মানুষের ভেতরে দুটি সত্ত্বা কাজ করে, তাই মানুষকে ভালো পথে রাখতে হলে ধর্মীয় সংবিধানের মধ্যে অন্তর্লীন করতে হয়। যে যে ধর্মেই থাকুক না কেন তার মূল কথাগুলো মেনে চললেই মানুষ সঠিক পথে থাকে।
একটি রাষ্ট্রে মানুষ যখন বিপথে যায়; হত্যা-লুণ্ঠন, রাহাজানি ধর্ষণসহ অপরাপর সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে মারাত্মকভাবে জড়িয়ে পড়ে তখন সে রাষ্ট্র ব্যবস্থা আস্তে আস্তে বর্বরতার দিকে ধাবিত হয়। এবং এই ধরনের বর্বর মানুষের রাষ্ট্রকে বর্বর রাষ্ট্র বলতেও কেউ কেউ দ্বিধাবোধ করে না। এই কারণেই দেশকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখতে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুনাম ও সুখ্যাতির সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য বর্বর জনগোষ্ঠীকে শক্ত হাতে শাসন করা প্রয়োজন হয়। যেহেতু মানুষ অনেক সময় স্বাভাবিক মানুষ থাকে না, হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, লুন্ঠন রাহাজানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সেই মানুষকে পরিপূর্ণভাবে মানুষ বলা যায় না। প্রাথমিকভাবে এই মানুষগুলোকে মোটিভেশনাল কার্যক্রমের মাধ্যমে সঠিক পথে আনার চেষ্টা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়বদ্ধতা।
কিন্তু যদি মানুষ তার বর্বরতা থেকে ফিরে না আসে ও নিজের দেশের বিরুদ্ধে যদি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তথা অন্য রাষ্ট্রের ক্রীড়ানকে পরিণত হয় এবং একের পর এক রাষ্ট্র ও সমাজবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তখন আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ শক্তভাবে করা ছাড়া উপায়ান্তর থাকে না।
যদিও সমাজে মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের মূল্যমান সমান। যেমন মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভোটের দাম এক একক। অপরপক্ষে একজন শ্রমিকের ভোটের দামও একক। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন ব্যক্তি নিয়ে আলোচনা হয়। কারণ ব্যক্তি বিশেষে মানুষের গুরুত্ব কমবেশি হয়। আর এই কমবেশি হওয়াটা পৃথিবীর সৃষ্টির শুরু থেকে এ পর্যন্ত আছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। পৃথিবীর যে সমস্ত উন্নত রাষ্ট্রকে আমরা কথায় কথায় উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করাই, সেখানেও আইনের চোখে সবাই সমান। মানুষ হিসেবে মানবাধিকার সমান। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রে সকলের গুরুত্ব সমান নয়।
ধরা যাক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কথা। সেখানে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের প্রেসিডেন্টের ওপরেও যে আইন প্রযুক্ত হয় একজন ট্যাক্সি ক্যাব চালকের ওপরও একইভাবে প্রযুক্ত হয়। আইনের চোখে সমান বিচার তারা পায়। অপরাধ করলে সমান বিচার হয়। অর্থাৎ সেখানে মানবাধিকার উন্নতমানের। অতিউৎকৃষ্ট মানের। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অতুলনীয়। মানুষ হিসেবে সেখানে সকলকে একই চোখে দেখা হয়। সবাই সমান ও সমধিকারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে একজন ট্যাক্সি ক্যাব চালক হোয়াইট হাউজের গেট খোলা পেয়ে গিয়ে হোয়াইট হাউজের ভেতরে প্রবেশ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অফিসের চেয়ারে বসে পড়বেন এবং বলবেন যে, আমরা সকলেই সমান অধিকারভুক্ত। আমরা মানুষ হিসেবে সকলেই সমান। সুতরাং আজকের থেকে আমি প্রেসিডেন্ট। এই সুযোগটি থাকে না। কারণ ব্যক্তি হিসেবে সকল রাষ্ট্রেই সকলের মূল্য ভিন্ন ভিন্ন।
এবার মূল কথায় ফিরি।
পেছনে ফিরে তাকানো যাক। ফ্যাসিস্ট আমলের দোর্দণ্ডপ্রতাপী পুলিশের হাতে শহীদ হলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা রাশেদ খান। এই হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের একটি। সেদিন এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানাভাবে আলোচনা হয়েছে সারাদেশে। তারপরও সত্যিকার অর্থে ন্যায়-নিরপেক্ষ বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে সেনা কর্মকর্তা। এই সেনা কর্মকর্তার বোনের চোখের অশ্রুর মূল্য কতো। পিতা-মাতা, সন্তানের অশ্রুর মূল্য কতো। আকাশ ও জমিনের সকল কিছু বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েও সে মূল্য চূড়ান্তভাবে অপরিশোধ্য।
সশস্ত্র বাহিনী আমাদের অহংকারের প্রতীক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে দেশের যেকোনো দুর্যোগ দুর্বিপাকে সশস্ত্র বাহিনী দেশের প্রয়োজনে সকলের আগেই অগ্রগণ্য। গত জুলাই আগস্টের গণহত্যার সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর যে অবদান, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর যে জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম, তা এ প্রজন্ম আমৃত্যু ভুলতে পারবে না। জুলাই আগস্টের গণঅভ্যুত্থান, গণআন্দোলন, গণবিদ্রোহের কথা যতই ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন হোক না কেনো, এতো দ্রুত এর সফল পরিণতি আসতো না, যদি দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী তাদের মৌন সমর্থন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি পাশে না দাঁড়াতেন।
আবার ৫ আগস্ট পরবর্তী ভারতের প্রেমের জলের কারণে যে প্রলয়ংকারী বন্যার কবলে পড়ল ফেনী ও নোয়াখালী অঞ্চল, সেই ফেনীতে সেনার সদস্যরা যেভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে, অসাধারণ মানবিক কাজ করেছে, বাংলাদেশের বহু মানুষ আনন্দে অশ্রু ফেলেছে যার যার ধর্ম অনুযায়ী। আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছে ওই অঞ্চলের সকল মানুষ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য। এভাবে দেশের সকল সংকটকালে সামনে এসে দাঁড়ায় সশস্ত্র বাহিনী।
অথচ এখন পরিকল্পিতভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট করার ভয়ংকর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে পরাজিতরা। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে অস্ত্রোদ্ধার অভিযান চলছে। সশস্ত্র বাহিনীর চৌকস দুর্মদ সদস্যরা এই কাজে সাহসিকতার সঙ্গে নিয়োজিত রয়েছেন। এই অরিন্দম বাহিনীর ২৩ বছরের এক শার্দুলবীর সেনানী লেফটেন্যান্ট তানজিম সারওয়ার ডাকাতের ছুরিকাঘাতে নিহত হলো। এই ডাকাত কারা? এরা কি বাংলাদেশের নাগরিক না অন্যদেশের? আমার দেশের সেনাবাহিনীকে স্পর্শ করার সাহস কোথায় পেল? এই সমস্ত ডাকাতদের উদ্দেশ্যেই বেহিসেবি গুলি খরচ প্রয়োজন। এদের বিচারের প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না।
মানুষ যখন বড় অপরাধী এবং পশু হয়ে যায় তখন বেঁচে থাকার অধিকার থাকে না। সেনাবাহিনীকে হত্যা করার সময় তারা বেপরোয়া। সেনা সদস্য হত্যা হলে মানবাধিকারের প্রশ্ন আসে না। ডাকাত হত্যা হলে মানবাধিকারের প্রশ্ন আসে! এ কেমন বৈষম্যমূলক মানবাধিকার! তাদের বিচার করতে গেলেই মানবাধিকারের প্রশ্ন আসবে! এটি নতুন বাংলাদেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্রের সমর্থন। এ ধরনের মায়াকান্নায় ভ্রুক্ষেপ না করে সারাদেশে যারা এ ধরনের ডাকাত রয়েছে তাদের রাজদণ্ড দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে এরা সেনাবাহিনীসহ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আরও নিষ্ঠুর হবে। সাধারণ মানুষ ঘর থেকে নিরাপদে বের হতে পারবে না।
পরাজিতদের হাতে মারাত্মক মারণাস্ত্র রয়েছে। সুযোগ পেলেই ঘুরে দাঁড়াবে এবং সেই অস্ত্র দিয়ে তারা লুটপাট এবং সন্ত্রাসের রাষ্ট্র কায়েম করবে। বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বহারা বা এ ধরনের কমিটি গঠন করে সংগঠন খুলে তারা আঞ্চলিকভাবে দেশকে একটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত করবে। ঢাকাসহ মেগাসিটিগুলোতে তারা ছিনতাই চাঁদাবাজি হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হবে। চতুর্দিক দিয়ে তারা এ ধরনের অসহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ড শুরু করলে সরকার স্বাভাবিক কাজ পরিকল্পিতভাবে এবং মনোযোগ দিয়ে করতে ব্যর্থ হবে। এলোমেলো পরিবেশে কোনো ইনোভেটিভ আইডিয়া আসে না। এলোমেলো পরিবেশে কখনো সৃষ্টিশীল হওয়া যায় না। এলোমেলো পরিবেশে নতুন কিছু করা যায় না। তাই নতুন বাংলাদেশকে নতুনভাবে উন্নত বাংলাদেশে পরিণত করতে হলে প্রয়োজন আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃষ্টান্তমূলক উন্নয়ন এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পরিবর্তন। এবং সেটা করতে হবে এখনই তো এখনই। তা না হলে পরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল হিসেবে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র চলমান থাকবে।
লেখক: ড. হাফিজ রহমান, কলামিস্ট ও গীতিকার