বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য দিবস আজ
তখন শারমিনের ১৩ বছর বয়স। শরীরে বয়োসন্ধিকালে কী পরিবর্তন হয়, তা জানার আগেই একদিন খুব ভোরে মাসিক হয় তার। মা লুকিয়ে শেখান কী কী করতে হবে। সকাল-সকাল বাবা দোকানে যান। পত্রিকায় মোড়ানো একটা প্যাকেট এনে মায়ের হাতে তুলে দেন। ভাইকে সরিয়ে দেওয়া হয় বিছানা থেকে। চারপাশের মানুষের আচরণে শারমিন বুঝতে পারে না— এখানে তার অপরাধটা কী? কেন সবাই বিরক্ত, কেন তাকে নানা ‘নিষেধ’ জাতীয় বিষয় বুঝিয়ে চলেছেন মা। শারমিন এখন ৩৪। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। এখনও ফার্মেসিতে গিয়ে প্যাড চাইলে সেটা পত্রিকায় মুড়ে দিতে দেখলেই সেই ১৩ বছর বয়সে ফিরে যান তিনি। দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে অজান্তেই।
শারমিনের বন্ধু আফরিন তার মাসিক শুরুর সময়ের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে হেসেই খুন। সে ছোটবেলার কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, আমি চাচির কাছে শুনেছি। চাচি বলছিলেন, আমি অসুস্থ। আমি বললাম, আমার কী হয়েছে? তিনি বললেন, প্রতি মাসে এখন থেকে তুমি অসুস্থ হবে। আর এই অসুস্থ হতে থাকাটাই সুস্থতা। যদি কোনও মাসে অসুখটা না হয়, তাকে জানাতে বললেন। আফরিনের প্রশ্ন, ১২ বছরের কোনও মেয়েকে এসব কথা বলাটা কীভাবে যৌক্তিক। সেতো ভয়েই মরে যাবে এবং আজীবনের জন্য ট্রমাতে পড়ে যাবে।
২০১৭ সালের ‘মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ম্যানেজমেন্ট অ্যামং বাংলাদেশি অ্যাডলসেন্ট স্কুল গার্লস অ্যান্ড রিক্স ফ্যাক্টরস অ্যাফেক্টিং স্কুল অ্যাবসেন্স: রেজাল্টস ফ্রম এ ক্রস সেকশনাল সার্ভে’ অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলে ৯১ শতাংশ স্কুলছাত্রী অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহার করে এবং ৮৬ শতাংশ বলছে— তাদের কাছে দাম (স্যানিটারি প্যাড) বেশি মনে হয়। এই জরিপে প্যাড ব্যবহারকারী নারীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত হয়— যথাযথ টয়লেটের অভাব এবং প্যাড পরিবর্তনের জন্য ঘরের বাইরে প্রাইভেট একটা জায়গা না থাকা।
‘প্র্যাকটিসেস অ্যান্ড ইফেক্টস অব মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ম্যানেজমেন্ট ইন রুর্যাল বাংলাদেশ’ শিরোনামে গবেষণা প্রবন্ধ বলছে, গ্রামীণ অঞ্চলের মাত্র ৯ শতাংশ স্কুলছাত্রী উন্নত জিনিস ব্যবহার করে। ৯১ শতাংশ অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহার করে, আর ৯০ শতাংশ নারী জানেন না— ব্যবহৃত প্যাড ফেলার প্রকৃত উপায় কী? তারা এমনভাবে সেটি করেন, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
শুধু লুকাতে গিয়েই মরণব্যাধিতে পড়ছে
‘ন্যাশনাল হাইজিন বেজলাইন সমীক্ষা’ অনুযায়ী, মাত্র ১০ শতাংশ স্কুলপড়ুয়া কিশোরী তাদের মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে। সমীক্ষায় বলা হয়, ৮৬ শতাংশ কিশোরী পুরনো কাপড়, ছেঁড়া কাপড় ব্যবহার করে। এর মধ্যে মাত্র ১১ শতাংশ মেয়ে সঠিক নিয়ম মেনে কাপড় ব্যবহার করে। বাকিরা ঘরের কোণায় কাপড় রাখে, লুকিয়ে শুকাতে দেয় ঘরের ভেতরেই। ফলে কাপড়টি সম্পূর্ণভাবে জীবাণুমুক্ত না হতেই আবারও ব্যবহার করতে হয়।
এই অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহার ক্যানসারের কারণ পর্যন্ত হতে পারে উল্লেখ করে দীর্ঘদিন মাসিক নিয়ে সুরক্ষা বিষয়ে কাজ করছেন এমন গবেষকরা বলছেন, একদিকে মাসিকের জন্য একটা অর্থ বরাদ্দ লাগে এবং কিনতে যাওয়া ঝামেলা মনে করেন বলে প্যাড বা উন্নত বিষয়গুলোর সঙ্গে অভ্যস্ত হতে চান না নারীরা। এটা নিয়ে জীবনসঙ্গীর সঙ্গেও তারা নিয়মিত আলাপ করেন— এমন কিছু তাদের গবেষণায় বা জরিপে উঠে আসেনি। দেশে প্রতি বছর ১৩ হাজার নারী মারা যাচ্ছে জরায়ুমুখের ক্যানসারের কারণে।
সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের যারা ঘরে থাকেন এবং কর্মজীবী নন, তাদের মধ্যে স্যানিটারি ব্যবহারের প্রবণতা মাত্র ১২ শতাংশ। দীর্ঘদিন অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহারের ফলে নারীদের জরায়ুমুখের ক্যানসার, ইনফেকশনসহ বিভিন্ন চর্মসমস্যা তৈরি হয়।
এটা কীভাবে বিলাসী পণ্য
মাসিক সুরক্ষা পণ্যের (স্যানিটারি প্যাড, টেম্পুন, মেন্সস্টুয়াল কাপ) উচ্চমূল্যের কারণে বেশিরভাগ নারীরা এসব সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হন। ওয়াটার এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান মনে করেন, এখন সময় হয়েছে বিষয়গুলো নিয়ে বেশি বেশি কথা বলার। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রায় ৪০ লাখ নারী গার্মেন্টসে চাকরি করেন। চড়া দামের কারণে তাদের স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের সুযোগ নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা অপরিচ্ছন্ন কাপড় ব্যবহার করে। এর ফলে নানা সংক্রমণে আক্রান্ত হন। এমনকি অসুস্থতার কারণে কাজে যেতে ব্যর্থ হন। এতে করে তাদের কাজের জায়গায় কথা শুনতে হয়। আবার দেশে এখনও ৩০ শতাংশ ছাত্রী মাসিকের সময় আড়াই দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে।’ এ অবস্থা থেকে উত্তরণে করণীয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাসিকের দিনগুলোতে সহজে ও কম খরচে ব্যবহারযোগ্য বিভিন্ন ধরনের পণ্য উদ্ভাবন হয়েছে। এর মধ্যে পোশাক শিল্পের নারীদের ঝুট কাপড় দিয়ে বানানো স্বল্প মূল্যের প্যাড, মেন্সট্রুয়াল কাপ অন্যতম। সেগুলো আরও বেশি বেশি ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’