কানাডার প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদ থেকে জাস্টিন ট্রুডোর পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে দেশটির ভবিষ্যৎ রাজনীতি কেমন হতে পারে সেটিই সম্ভবত বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে ট্রুডোর পদত্যাগ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, কানাডার জনগণ নিজের দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হিসেবে দেখতে চায়। আর এ বিষয়টি বুঝতে পেরেই পদত্যাগ করেছেন ট্রুডো। এ খবর জানিয়েছে সিএনএন।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডার একীভূত হয়ে দেশটির ৫১তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হওয়া উচিত বলে জানিয়ে নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে পোস্টও করেছেন ট্রাম্প।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পরিস্থিতি যে খুব একটা সুখনীয় অবস্থায় নেই তা ট্রাম্পের লোভনীয় প্রস্তাবে অনেকটাই স্পষ্ট। তবে মোটা দাগে এটুকু ধরা যেতে পারে, নিজের ছোট রাজ্য হলেও তা অন্যের অধীন হওয়ার চেয়ে ভালো। পরিস্থিতি উল্টোপথে চলার আগেই একমাত্র সমাধান হতে পারে নির্বাচন।
জাস্টিন ট্রুডোর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে খারাপ সপ্তাহ দেখেছে বিশ্ব। তার এই কঠিন সময়কে তিনি নিজে পারিবারিক ঝগড়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ তা নিশ্চয়ই তিনি বা তার দল মিটিয়ে নেবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা দলীয় প্রধান হিসেবে তিনি থাকবেন না।
হঠাৎ কেন এমন সিদ্ধান্ত?
ট্রুডোর মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করলে তার দলের কিছু সদস্য তাকেও পদত্যাগ করার আহ্বান জানান। তবে ট্রুডো সেসময় পদত্যাগ করার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। তবে সময় গড়াতে গড়াতে আগুনের আঁচ বেড়ে যাওয়ায় নতুনভাবে ভাবতে হয়েছে ট্রুডোকে। দিতে হয়েছে পদত্যাগের ঘোষণা।
ট্রুডোর জনপ্রিয়তাও দিনদিন কমছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের ইপসোসের একটি জরিপে দেখা যায়, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কানাডিয়ান তার প্রতি অসন্তুষ্ট। মাত্র ২৬% নাগরিক তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পছন্দ করেন, যা কনজারভেটিভ নেতা পিয়েরে পয়লিয়েভের চেয়ে ১৯ পয়েন্ট কম। শুধু তাই নয়, তার নিজের দলের মধ্যেও সমর্থন কমছে। এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১৮ জন লিবারেল এমপি তাকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন। দেশটির নিউ ব্রান্সউইকের এমপি ওয়েন লং দাবি করেন, লিবারেলদের ১৫৩ জন এমপির মধ্যে প্রায় ৫০ জন চান ট্রুডো যেন অবিলম্বে সরে দাঁড়ান।
এমন এক সময়ে ট্রুডো যদি দ্রুত সময়ের ভেতর পদত্যাগ না করেন তবে তা তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে স্থায়ী ক্ষত তৈরি করতে পারে বলে ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ অবস্থায় দেখা যাক। কোন পথ বেছে নিতে ট্রুডো পছন্দ করেন।
লিবারেলদের নেতৃত্ব দেবেন কে?
এদিকে ট্রুডোর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘিরে কিছু প্রশ্ন সামনে এসেছে। দেখা দিয়েছে কিছু জটিলতাও। সোমবার (৬ জানুয়ারি) কানাডিয়ানদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময় ট্রুডো জানান, দেশের গভর্নর জেনারেল তার পার্লামেন্ট স্থগিত করার (প্ররোগেশন) অনুরোধ গ্রহণ করেছেন। এই প্ররোগেশন পার্লামেন্টকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত রাখবে।
প্ররোগেশনের সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই লিবারেল ককাস নতুন নেতা নির্বাচন করার চেষ্টা করবে, যদিও সেই নেতা কীভাবে নির্বাচিত হবেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। সাধারণত, কানাডার ফেডারেল দলের নেতারা চার থেকে পাঁচ মাসের একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত হন, যার মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব সম্মেলন অন্তর্ভুক্ত থাকে।
ট্রুডোর উত্তরসূরি কে হবেন তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে কয়েকজন বিশিষ্ট লিবারেল নেতার নাম শোনা যাচ্ছে, যাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড, পরিবহনমন্ত্রী আনিতা আনন্দ এবং সাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকার মার্ক কার্নি।
এদিকে বামঘেঁষা নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এনডিপি) নেতা জগমীত সিং বলেন, তিনি লিবারেল পার্টিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ভোট দেবেন, নেতা যেই হোক না কেন। তিনি বলেন, লিবারেলদের আর একটি সুযোগ পাওয়ারও অধিকার নেই। যদিও এনডিপি ট্রুডোকে যথেষ্ট ভোট দিয়ে তার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছিল।
কানাডার নির্বাচন কবে?
কানাডার পরবর্তী ফেডারেল নির্বাচন অক্টোবরের মধ্যে হতে হবে, তবে এর আগেই ভোট ডাকার সম্ভাবনা রয়েছে। জনমত জরিপে দ্বিগুণ অঙ্কের ব্যবধানে এগিয়ে থাকা বিরোধী কনজারভেটিভ পার্টি গত কয়েক মাস ধরে হাউস অব কমন্সে একাধিক অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন ডাকার চেষ্টা করছে।
প্ররোগেশন পার্লামেন্টকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত থাকাত পর আর বেশিদিন সরকার পরিচালনা করার সুযোগ পাবে না লিবারেল পার্টি। প্ররোগেশন শেষ হওয়ার পর প্রথম ভোট হবে আস্থা ভোট। যদি সরকার এই আস্থা ভোটে হেরে যায়, তবে সরকার পদত্যাগ করবে বা পার্লামেন্ট ভেঙে ফেডারেল নির্বাচনের ডাক দেবে। জনমত জরিপে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, যদি কানাডার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে আনুষ্ঠানিক বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টি নিরঙ্কুশ জয়লাভ করবে।
কনজারভেটিভ পার্টি ও দলটির নেতা কে?
জনমত জরিপ সঠিক হলে কানাডার কনজারভেটিভ পার্টির নেতা পিয়েরে পয়লিয়েভ দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সবচেয়ে প্রবল সম্ভাব্য প্রার্থী। ২০২২ সালে তার দলের নেতৃত্ব গ্রহণের পর থেকে, পয়লিয়েভ প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর জন্য এক কঠিন প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি বারবার ট্রুডোকে আগাম নির্বাচনের ডাক দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছেন।
পয়লিয়েভ অ্যান্টি-এলিট এবং অ্যান্টি-ট্রুডো নেতা হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেছেন এবং সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে নিজের পরিচিতি গড়ে তুলেছেন। এপ্রিল মাসে, একটি প্রশ্নোত্তর পর্ব চলাকালে ট্রুডোকে উন্মাদ এবং চরমপন্থি বলে অভিহিত করার জন্য ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করায় তাকে পার্লামেন্ট থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। বিবিসি