গাজার রাফাতে ইসরায়েলের হামলার মধ্যে ‘All Eyes On Rafah’ লেখাসহ একটি এআই নির্মিত ছবি ৪০ মিলিয়নেরও বেশি বার শেয়ার করা হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
‘All Eyes On Rafah’ লেখা সম্বলিত ইন্সটাগ্রামের একটি ছবি সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেয়ে গেছে, ঠিক যে সময় ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের নিমর্মতার চূড়ান্ত প্রদর্শনী চলছে গাজার রাফা শহরে।
গাজার রাফাহতে ইসরায়েলের বর্বোরোচিত হামলার একদিন পরে অর্থাৎ সোমবার থেকে ৪০ মিলিয়নেরও বেশি ইনস্টাগ্রামের স্টোরিগুলোতে শেয়ার হয়েছে শক্তিশালী এক বার্তা লেখা ছবিটি। ছবিটির আদ্যোপান্ত জেনে নিন এবার…
সবার চোখ রাফাহতে কেনো?
• All Eyes On Rafah হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সহয়তায় নির্মিত একটি ছবি যা একটি বৃহৎ বার্তা বহন করছে। মিশর সীমান্তের নিকটবর্তী গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফাহ যেখানে বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতির দিকে সকলের দৃষ্টি আটকে রাখাই বার্তাটির প্রতীকী অর্থ। ছবিটি যেনো ভয়াল আর্তনাদে চোয়াল শক্ত করে বলতে চাইছে আমরা সকলেই সেদিকে তাকিয়ে আছি কিভাবে সেখানকার নিষ্পাপ শিশুরা মৃত্যুর যন্ত্রণাকে আলিঙ্গন করে। কতটা নির্দয় হতে পারো হও দেখি!
• গাজায় ইসরায়েল আক্রমন শুরুর পর প্রথমে উত্তর গাজা থেকে বোমা ফেলা শুরু করে এবং নীচের দিকে এগোতে থাকে। তারা ফিলিস্তিনিদেরকে বাস্তুচ্যুত করে দক্ষিণে পালিয়ে যাওয়ার জন্য। নিরীহ ফিলিস্তিনরা আশ্রয়ের খোঁজে প্রাণভয়ে গাজার দক্ষিণে পালিয়ে যায়।
• ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি গাজার ২.৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নিরস্ত্র ও বেসামরিক নাগরিককে রাফাহতে জোরপূর্বক ঠেলে দেওয়া হয়। ঠিক তার পরবর্তী সময়ে নেতানিয়াহু ঘোষণা দেয় তারা রাফাহ শহরে একটি স্থল অভিযানের পরিকল্পনা করেছে হামাসের ঘাঁটি থাকার সন্দেহে।
• এই ঘোষণায় বিশ্বব্যাপী তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে। ফেব্রুয়ারিতে, গাজা এবং দখলকৃত পশ্চিম তীরের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি, রিচার্ড ‘রিক’ পিপারকর্ন বলেছিলেন, সবার নজর এখন রাফাহর দিকে রয়েছে, সেখানে কি ঘটতে চলেছে তা দেখার জন্য। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ফিলিস্তিনি-ইরাকি-আমেরিকান শিল্পী ও গবেষক আমিরা কাওয়াশ, কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরাকে বলেছিলেন “রাফাহর উপর সকলের চোখ থাকবে”। সম্ভবত কাওয়াশের ওই বক্তব্য থেকে অনুপ্রানিত হয়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রেন্ড শুরু হয় ভাইরাল বার্তা সম্বলিত ছবিটির।
• তারপর থেকেই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই বার্তাটি হয়ে উঠেছে নিরব প্রতিবাদের শক্তিশালী উপকরণ।
রাফায় আসলে কি হচ্ছে?
রবিবার (২৬ মে), আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ইসরায়েলকে রাফাহর উপর আক্রমণ বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার দু’দিনের মধ্যেই ইসরায়েল বোমা হামলায চালায়। হামলায় পশ্চিম রাফাহর আল-মাওয়াসিতে কমপক্ষে ৪৫ জন নিহত হয়। আল-মাওয়াসিকে আগে একটি নিরাপদ অঞ্চল হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
মঙ্গলবার (২৮ মে) রাফাহর পশ্চিমে একটি অস্থায়ী শিবিরে ইসরায়েলের আক্রমণে ২১ জন প্রাণ হারায়। নিহতদের মধ্যে কমপক্ষে ১২ জন মহিলা ছিলেন। বুধবার (২৯ মে) সকালে আরেকটি বিমান হামলার খবর পাওয়া গেছে। পুরো ফিলিস্তিন যেনো নিশ্চিহ্ন করার মিশনে নেমেছে ইজরায়েলি বাহিনী।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের বরাতে জানা গেছে, ইসরায়েল গত অক্টোবর থেকে গাজায় হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ৩৬ হাজার ১৭১ জনকে হত্যা করেছে। বিধ্বস্ত গাজায় নিখোঁজ রয়েছে এখনো অসংখ্য মানুষ।
আলোচিত All Eyes On Rafah ছবির মধ্যে বিশেষ কী আছে?
• কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বানানো একটি ছবি, যেখানে দেখা যাচ্ছে তুষারাবৃত একটি প্রান্তরে অসংখ্য সুশৃঙ্খল তাবুর সারি। মাঝখানে কিছু হালকা রঙের তাঁবু সাজানো, যা ফুটিয়ে তুলেছে আলোচিত সেই উক্তি ‘All Eyes On Rafah’ লেখাটি। পিছনে তুলোর পাজা সদৃশ মেঘের সাথে একটি স্বচ্ছ নীল আকাশ।
• এখানেই শেষ নয়। অতি সাধারণ এই ছবিটির ভাবার্থ আসলে এর চেয়েও গভীর। রাফাহ শহরের আকাশ ইসরায়েলি বোমার ধোঁয়ায় ধূসর হয়ে আছে এবং সত্যিকার অর্থে সেখানে কোনও গোছানো তাঁবু নেই।
• জাতিসংঘ জানিয়েছে, রাফাহতে এখন অনেক মানুষের জটলা। অনেক বেশি মানুষ সেখানে অবস্থান করছেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। আশ্রয়ের খোঁজে আশা মানুষের সংখ্যাটা নেহাতই কম নয় । আনুমানিক ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন লোক আশ্রয় চাইছে সেখানে।
কারা এই ছবিটি শেয়ার করছে বিশ্বব্যাপী?
সবচাইতে বেশি শেয়ার করছে ইন্সটাগ্রাম ব্যবহারকারীরা। তবে বাংলাদেশে সবচাইতে বেশি শেয়ার হচ্ছে ফেসবুকে। বুধবার (২৯) পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী এটি ৪০ দশমিক ৪ মিলিয়ন ইন্সটাগ্রাম ব্যবহারকারীর স্টোরিতে স্থান পেয়েছে।

তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য:
আমেরিকান সুপারমডেল বেলা হাদিদ। যিনি ফিলিস্থিনি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক। বিশ্বজোড়া পরিচিতি আছে বেলার। নেটফ্লিক্সের ব্রিজারটন খ্যাত আইরিশ অভিনেত্রী নিকোলা কফম্যান। আমেরিকান কৌতুক অভিনেতা এবং লেখক, হাসান মিনহাজ, পাশাপাশি আমেরিকান অভিনেতা অ্যারন পলও শেয়ার করেন।
ব্রিটিশ অভিনেতা এবং সমাজকর্মী জামিলা জামিল এবং ব্রিটিশ গায়ক ডুয়া লিপাও আছেন এ তালিকায়। অন্যদিকে ভারতের বলিউডের অনেক অভিনয়শিল্পীও আলোচিত ছবিটি শেয়ার দেন। বরুণ ধাওয়ান, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া জোনাস, আলিয়া ভাট, হানি সিং, জেরিন খান, মালাইকা অরোরা, সোনম কাপুর, নোরা ফাতেহি, দুলকার সালমান, তৃপ্তি দিমরি, সামান্থা রুথ প্রভু, রাকুলপ্রিত সিং এবং কারিনা কাপুর খান উল্লেখযোগ্য।

সোমবার (২৭ মে) ছবিটি প্রথম ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতেভ পোস্ট করে @shahv4012 নামের একজন ব্যবহারকারী। তবে এই ব্যবহারকারী ছবিটি তৈরি করেছেন কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ইনস্টাগ্রাম ছাড়াও, ছবিটি টুইটার এক্সেও অসংখ্য শেয়ার করা হয়েছে।
কেনো ‘All eyes on Rafah’ এত ভাইরাল হলো?
গাজার অনেক মর্মান্তিক ছবির চেয়ে এই ছবিটি মানুষকে অনেক বেশি নাড়া দিয়েছে।
একটি কারণ হতে পারে ছবিটি ইন্সটাগ্রামের ‘Add Yours’ ফিচার দিয়ে শেয়ার করা যাচ্ছে খুব সহজেই যা ছবিটির ব্যাপারে সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য আলাদা করে সময় নিচ্ছে না ব্যবহারকারীদের। সেকেন্ডের মধ্যে শেয়ার করা যাচ্ছে।
এছাড়া অনেক তারকা কিংবা ‘সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার’রা আগে এই যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে প্রকাশ্যে বাক্যব্যয় না করলেও এই ছবিটি শেয়ার দিয়ে সহজেই নিজেদের একাত্মতা প্রকাশ করছে। তাদের দেখাদেখি তাদের ভক্তগণও নিজেদের জুড়ে নিচ্ছে এর সাথে।
কাতারের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক এডি বোর্হেস রে, তিনি আবার মনে করেন গাজার বাস্তব যে চিত্র যেমন, সর্বদা হিংস্রতা,রক্ত কিংবা মৃতদেহ এসবের ছবি মানুষের মনে নাড়া দিলেও তা সব সময় তারা শেয়ার করেন না। এক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বানানো ছবিটি অনেক ব্যবহারকারীদের কাছে কিছুটা সহনশীল অথবা মনোরম হতে পারে যে কারণে তারা খুব সহজেই শেয়ার করছে ছবিটি।

All eyes on Rafah’ পরবর্তী করণীয় কী?
এটি একটি বড় প্রশ্ন চলমান ট্রেন্ড একসময় নিভে যাবে কিন্তু তারপর? তারপরের লক্ষ্য কী? করণীয় কী? কারণ রাফাতে ইসরায়েলের আক্রমণ ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। অন্যদিকে এআই নির্মিত ছবিটি ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। যদিও ছবিটি দক্ষিণ গাজা শহরের ভয়াবহ চিত্র বিশ্বব্যাপী তুলে ধরতে সহায়তা করছে।
অনেকে মনে করছেন ছবিটিতে যুদ্ধ বন্ধের আহবানও যুক্ত করা উচিত ছিলো যাতে অবিলম্বে এর অবসান হয়।
সাকিবুর রহমান
শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, এনইউবিটি
স্টাফ রিপোর্টার, প্রতিদিন সেবক