খুলনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। প্রায় প্রতি রাতেই কোথাও না কোথাও চলছে সন্ত্রাসীদের সংঘাত, হচ্ছে সংঘর্ষ। এতে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। গত সোমবার ৯ ঘণ্টার ব্যবধানে পৃথক তিনটি স্থানে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এতে একজন নিহত হন, একজনের আঙুল ও একজনের কবজি কেটে যায়।
পুলিশের তথ্য বলছে, গত চার মাসে খুলনা জেলা ও মহানগরীতে ১০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গুরুতর জখম হয়েছে অনেক মানুষ। প্রতিটি ঘটনার পেছনে মাদক বিক্রেতা ও এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযানও চলছে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ সাধারণ মানুষ।
সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুরাতন রেলস্টেশন এলাকায় নগরীর ২১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মানিক হাওলাদারকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জখম করা হয়। বিকেলে তিনি মারা যান। সন্ধ্যা ৬টায় নগরীর আযমখান কমার্স কলেজের ভেতরে সন্ত্রাসীরা নওফেল নামে এক যুবককে কুপিয়ে তাঁর আঙুল বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে নগরীর বয়রা শশ্মানঘাট এলাকায় সজীব শিকদার নামে আরেক যুবককে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়।
এর আগের দিন রোববার রাতে ২৭ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহীনকে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। গুলিটি তাঁর ফুসফুসে আটক গেছে। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। এমন আহতের তালিকা দীর্ঘ।
ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা জানান, ওএমএসের লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে কথা কাটাকাটি জেরে মানিককে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে রেলওয়ে এলাকার মাদক বিক্রি ও তেল সিন্ডিকেট সদস্যরা জড়িত। একাধিক মামলা থাকলেও তারা এলাকায় অবস্থান করছিল। বয়রা শশ্মানঘাট এলাকায় সংঘর্ষে সন্ত্রাসী কালা লাভলু ও সাগর গ্রুপ জড়িত। কমার্স কলেজের ভেতরে নওফেলকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা জড়িত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়ে। এ সুযোগে পুরোনো সন্ত্রাসী ও মাদক বিক্রেতারা এলাকায় ফিরে এসেছে। অনেকে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে তারা সংঘাতে জড়াচ্ছে। বেশির ভাগ থানায় পুলিশের নতুন কর্মকর্তা যোগ দিয়েছেন। স্থানীয় সন্ত্রাসীদের চিনতে তাদের সময় লাগছে। বড় সন্ত্রাসীরা ধরা পড়লেও উঠতিরা গ্রেপ্তার হচ্ছে কম। এতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
খুলনা সদর থানার ওসি মুনীর উল গিয়াস বলেন, সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরি করে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে। যুবদল নেতা মানিক হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি মেহেদী ঘটনার পর পালিয়ে যায়। তার বড় ভাই সাজ্জাদ হাওলাদার ও বোন তুলিকে আটক করা হয়েছে।
নগরীর হরিণটানা থানার ওসি শেখ খায়রুল বাসার বলেন, হরিণটানা থানা এলাকার সন্ত্রাসী কালা লাভলু ও সাগর গ্রুপের সদস্য ছিল সজিব। গ্রুপ দুটির মধ্যে বেশ কয়েক দিন ধরে দ্বন্দ্ব ছিল। এর জের ধরেই সজিবকে কুপিয়ে জখম করা হয়। আগে সন্ত্রাসীরা গ্রেপ্তার না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযানের খবর পেয়ে তারা পালিয়ে যায়। তবে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
নগরবাসীর অভিযোগ, পুলিশ অভিযানের কথা বললেও দৃশ্যমান তৎপরতা চোখে পড়ছে না। বেশির ভাগ এলাকাতেই প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা অস্ত্রসহ মহড়া দিচ্ছে। পুলিশকে জানালেও তারা আসছে দেরি করে।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। তাদের মধ্যে এখন আগের মতো ভয় নেই। এতে অস্ত্রের মহড়া ও হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে।
খুলনা মহানগর পুলিশের কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, দেশে সার্বিক অস্থিরতা, পুলিশের স্বাভাবিক হতে সময় লাগাসহ নানা কারণে সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে পুলিশের নানামুখী তৎপরতা চলছে। ১২ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা তৈরি করে গ্রেপ্তারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত অভিযান চলছে। বাকিদেরও শিগগির গ্রেপ্তার করা হবে।