শ্রীলঙ্কার সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকশেকে টার্গেট করে ২০০৬ সালে কলম্বোয় চালানো হয়েছিল আত্মঘাতী এক বোমা হামলা। প্রাণে বেঁচে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসেছিলেন সেসময় দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গোতাবায়া। ওই হামলার ঘটনা বদলে দিয়েছিল শ্রীলঙ্কার ইতিহাস।
কারা হামলা চালিয়েছিল তার ওপর? কেন তিনি ছিলেন হামলাকারীদের টার্গেট?২০০৬ সালে ডিসেম্বরের গোড়ায় শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পালি পালিহাক্কারা যাচ্ছিলেন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করতে কলম্বোয় তার সরকারি বাসভবন টেম্পল ট্রিতে। তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকশে।
প্রেসিডেন্ট এবং সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ডি-ব্রিফিং বৈঠক করতে যাচ্ছিলেন পালিহাক্কারা।
তারা তখন প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে ট্রাফিক সিগনালে অপেক্ষা করছিলেন। তার কয়েকটা গাড়ি আগে অন্য একটা গাড়িতে ছিলেন গোতাবায়া রাজাপাকশে। তিনিও যাচ্ছিলেন ওই বৈঠকে যোগ দিতে।
বিবিসির ইতিহাসের সাক্ষী অনুষ্ঠানের জন্য দেওয়া সাক্ষাৎকারে পালিহাক্কারা বলেন, ট্রাফিক আলো সবুজ হবার পর গাড়িগুলো যখন চলতে শুরু করেছে, তখন হঠাৎ তিনি দেখলেন রাস্তার অন্যদিকে একটা তিন চাকার টুকটুক। সেটা হঠাৎ তাদের দিকে মুখ ঘোরাল আর সঙ্গে সঙ্গে ঘটল প্রচণ্ড বিস্ফোরণ।
তিনি আরও বলেন, “হঠাৎ মনে হল যেন বিকট শব্দে বাজ পড়েছে। গাড়ির ভেতর চালক আর আমি একেবারে হতচকিত হয়ে গেলাম। কী হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমাদের গাড়ি থেকে বিশ ফুটেরও কম দূরে কিছু ঘটেছে। আমরা প্রচণ্ডরকম হতভম্ব।
তিনি আরও বলেন, “হঠাৎ করেই সব শব্দ থেমে একটা নিথর নিরবতা নামল। এরপর পোড়া টায়ারের গন্ধ পেলাম। তখন বুঝলাম বোমা ফেটেছে। ভাগ্যক্রমে গাড়ির মাথার হুড খোলা ছিল। আমি ও ড্রাইভার সেখান দিয়ে বেরিয়ে এলাম। পাশেই একটা গাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলছিল।
বিভ্রান্ত ও হতচকিত পালি পালিহাক্কারা তখন নিরাপদ একটা জায়গা খুঁজছিলেন।
তিনি বলছিলেন, পথচারীরা তখন তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন। তারা দুজনেই গুরুতর আহত না হয়ে কীভাবে যে বেরিয়ে এসেছিলেন তা এখনও তার কাছে একটা বিরাট বিস্ময়।
তিনি জানান, “বিস্ফোরণের পরপরই শুনলাম সেসময় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর গাড়িও ওই মোড় পার হচ্ছিল এবং বিস্ফোরণে তার গাড়ির অনেক ক্ষতি হয়েছে।”
টাইগারদের সঙ্গে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গোতাবায়া রাজাপাকশেকে লক্ষ্য করে এই আত্মঘাতী হামলা যখন চালানো হয়, তখন শ্রীলঙ্কা সরকার ও তামিল টাইগারদের মধ্যেকার এক চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকার কথা ছিল।
টাইগাররা মনে করত শ্রীলঙ্কায় তামিল সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখা হচ্ছে। তারা চেয়েছিল শ্রীলঙ্কার উত্তর পূর্বে একটা স্বাধীন রাজ্য গঠন করতে এবং সেই লক্ষ্যে ১৯৮৩ সাল থেকে তারা সিনহালা প্রধান সরকারের সঙ্গে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ চালাচ্ছিল।
দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায়ই আসত বিস্ফোরণ, হামলা আর ধ্বংসযজ্ঞের নানা খবর। কলম্বোর ওপর এর আগেও আত্মঘাতী হামলা বহুবার হয়েছে। কিন্তু ২০০৬ সালের ওই হামলার মত বিধ্বংসী হামলা টাইগাররা তার আগে চালায়নি।
টাইগাররা ইতোমধ্যেই সরকারের আরও বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, কর্মকর্তা এমনকি সেনা প্রধান জেনারেল সারাথ ফনসেকাকেও তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু করেছিল।
গোতাবায়া রাজাপাকশে ছিলেন তাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট। কারণ প্রথমত তিনি ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, একইসঙ্গে তিনি ছিলেন সেসময় দেশটির প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকশের ভাই।
পরের তিন বছর শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ একটা নির্মম চেহারা নেয়। দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই নৃশংসতার অভিযোগ ওঠে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গোতাবায়া রাজাপাকশের নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী ২০০৯ সালে টাইগারদের পরাস্ত করে এবং তাদের নেতাকে হত্যা করে।
যুদ্ধে জয়লাভের পর তামিল জনগোষ্ঠীর ওপর নিষ্ঠুর প্রতিশোধমূলক তৎপরতা চালানোর অভিযোগ ওঠে রাজাপাকশে প্রশাসনের বিরুদ্ধে।
কিন্তু শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনহালা জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের কাছে যুদ্ধ জয়ের নায়ক হয়ে ওঠেন রাজাপাকশে পরিবার।
ওই আত্মঘাতী বোমা হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যাবার ১৩ বছর পর ২০১৯ সালে গোতাবায়া রাজাপাকশে শ্রীলঙ্কার অষ্টম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
পি এস / এন আই