এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বিমান ও প্রতিরক্ষা প্রদর্শনী ‘অ্যারো ইন্ডিয়া’ প্রতিবারই অস্ত্র বাণিজ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তবে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়া এবারের আসর ছিল আরও উত্তেজনাপূর্ণ। এর একটি বড় কারণ ছিল রাশিয়ার উন্নততম স্টিলথ যুদ্ধবিমান এসইউ-৫৭’র উপস্থিতি। এটি শুধু ভারতে প্রথমবার প্রদর্শিত হয়নি, বরং প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি সমতুল্য এফ-৩৫’র সঙ্গে একই মঞ্চে এসেছিল।
এর মধ্যেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর যুক্তরাষ্ট্র সফর এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তার বৈঠকও নজর কাড়ে। ওই বৈঠকে দুই নেতা বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর ঘোষণা দেন। তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ট্রাম্পের মন্তব্য, যেখানে তিনি বলেন, তারা ভারতকে এফ-৩৫ সরবরাহের পথ তৈরি করছেন। বর্তমানে এই যুদ্ধবিমান কেবল মার্কিন মিত্র দেশগুলোর জন্যই সংরক্ষিত।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রতিযোগিতা
এই ঘোষণার ফলে বেঙ্গালুরুতে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হয়, যেখানে সামরিক কর্মকর্তা ও অস্ত্র নির্মাতারা ভারতের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। তারা রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ধীরে ধীরে সরবরাহ ব্যবস্থা বৈচিত্র্যময় করার চেষ্টা করছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, ট্রাম্পের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন এবং ভারতের সম্ভাব্য ১১৪টি যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা—সব মিলিয়ে প্রতিযোগিতা এবার আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।
রুশ ও মার্কিন প্রতিনিধিরা সরাসরি মুখোমুখি না হলেও একে অপরের প্রযুক্তির সমালোচনা করতে ছাড়েননি। রাশিয়ার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এফ-৩৫ শুধু দুর্বলভাবে সজ্জিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে এসইউ-৫৭ ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে ‘পরীক্ষিত’। অন্যদিকে, মার্কিন কর্মকর্তারা ইউক্রেনে রুশ অস্ত্রের দুর্বলতার কথা তুলে ধরে এসইউ-৫৭’র কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
ভারতের সামনে কঠিন সিদ্ধান্ত
ভারত যদি মার্কিন যুদ্ধবিমান কেনে, তবে তা দু’দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। ভারত এরই মধ্যে মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম—যেমন হেলিকপ্টার, পরিবহন প্লেন ও ড্রোন— কিনেছে, তবে যুদ্ধবিমান কেনা হয়নি। ২০১৬ সালে ভারত ৩৬টি ফরাসি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনে। বর্তমানে ভারতের অধিকাংশ যুদ্ধবিমান রুশ-উৎপাদিত।
ভারতের আসন্ন ১১৪টি যুদ্ধবিমান কেনার টেন্ডার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। এটি এ বছর আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্ভাব্য প্রতিযোগীদের মধ্যে রয়েছে মার্কিন কোম্পানি বোয়িং ও লকহিড মার্টিন, ফরাসি দাসোঁ, সুইডিশ সাব এবং রাশিয়ার ইউনাইটেড এয়ারক্রাফট করপোরেশন।
তবে ভারত চতুর্থ প্রজন্মের তুলনামূলকভাবে কম খরচের যুদ্ধবিমান খুঁজছে, যাতে পুরোনো বিমান প্রতিস্থাপন ও ঘাটতি পূরণ করা যায়। এফ-৩৫র মতো ব্যয়বহুল পঞ্চম প্রজন্মের স্টিলথ যুদ্ধবিমান কেনা এই কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ভারত নিজের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান উন্নয়নেরও চেষ্টা করছে।
এদিকে, চীন এরই মধ্যে প্রায় ২০০টি পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং পাকিস্তানকে ৪০টি সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে। তাই ভারতীয় প্রতিরক্ষা মহলে ১১৪টি যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনার আহ্বান উঠেছে। অনেকে বলছেন, ভারতের উচিত ছোট পরিসরে স্টিলথ যুদ্ধবিমান কেনা।
রাশিয়ার চাপ ও মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা
রাশিয়াও ভারতকে এ পথে নিতে চাইছে। তারা এসইউ-৫৭র প্রযুক্তি ভাগ করে নেওয়া ও ভারতে উৎপাদনের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা আগেও এসইউ-৩০ যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে এমনটি করেছিল। রুশ কর্মকর্তারা দাবি করছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হলে তাদের সরবরাহ ব্যবস্থা আরও স্বাভাবিক হবে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন, বিশেষ করে ভারতীয় যুদ্ধবিমানের জন্য মার্কিন ইঞ্জিন সরবরাহে দেরির বিষয়টি তুলে ধরছে মস্কো।
এদিকে, ট্রাম্পের এফ-৩৫র প্রস্তাব ভারতীয় ও মার্কিন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। ভারতের উদ্বেগ হলো, অতিরিক্ত আমদানি নির্ভরশীলতা তার কৌশলগত স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে। পাশাপাশি, মার্কিন মিত্ররাও ভারতের সঙ্গে অত্যাধুনিক এফ-৩৫ প্রযুক্তি ভাগাভাগি করতে চাইবে কি না, সেটিও অনিশ্চিত।
মোদীর সঙ্গে বৈঠকে ট্রাম্প জানান, যুক্তরাষ্ট্র ভারতে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান সরবরাহ নীতিমালা পর্যালোচনা করছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা অবশ্য বলেছেন, এটি এখনো প্রস্তাব মাত্র, আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। তবে এটি নিশ্চিত যে, সামরিক চুক্তি নিয়ে আগামী মাসগুলোতে তুমুল কূটনৈতিক লড়াই চলবে।