রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একের পর এক ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এর প্রতিরোধে ঢাকা উদ্যানে আজ রোববার একটি অস্থায়ী আর্মি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেড এই ক্যাম্প বসিয়েছে। মেজর ফজলে বারী জানান, এই ক্যাম্পটি ঢাকা উদ্যান এবং চন্দ্রিমা উদ্যান এলাকার নিরাপত্তায় কাজ করবে। আরও একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হবে।
এদিকে ঢাকা উদ্যান, একতা, নবোদয়, নবীনগর ও শ্যামলী হাউজিং এবং তুরাগ নদসংলগ্ন ওয়াকওয়েতে প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে এমন পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে। দিনের আলো নিভলেই জেঁকে বসছে আতঙ্ক। এ আতঙ্ক ছিনতাইয়ের। স্থানীয়রা জানান, একদল উচ্ছৃঙ্খল যুবক চাপাতি হাতে দৌঁড়ায় আর কোপায়। সামনে যাকে পায়, কুপিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। রেহাই পান না দোকানিরাও।
এদিকে গতকাল শনিবার বিকেলে মোহাম্মদপুরের অন্তত ৬০ বাসিন্দা থানায় গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে ৭২ ঘণ্টার সময়সহ পাঁচ দাবি জানান। এর মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে থানায় অবস্থানের ঘোষণা দেন তারা।
সরেজমিন গতকাল দুপুরে কথা হয় কুলসুম বেগমের সঙ্গে। সমকালকে তিনি বলেন, বাসা থেকে নেমে তিনজন হাঁটছি। ৪ নম্বর সড়ক মোড়ে পৌঁছে দেখি ২৫-৩০ যুবক দৌড়াচ্ছে, হাতে চাপাতি। সামনে যাকে পাচ্ছে, কুপিয়ে সব কেড়ে নিচ্ছে। ডাকাত, ডাকাত চিৎকার করতেই আমরাও শিকারে পরিণত হলাম। ভাই ও তার ছেলেকে কোপাল; আমাকে পেটাল লোহার পাইপ দিয়ে। সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন ও ১৫ হাজার টাকা কেড়ে নিল। সাহায্য চাইলেও কেউ আসেনি। দোকানিরা সাটার নামিয়ে দেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে আধা ঘণ্টায় মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের ডি ব্লক ও একতা হাউজিংয়ে অন্তত ৩০ জন ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। লুট হয় বিভিন্ন দোকানেও। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে পাঁচজন গুরুতর জখমসহ ২৫ জন আহত হন।
দোকানিরা জানান, যে সড়কে মানুষের চলাচল কম, আতঙ্কে সন্ধ্যার আগেই তারা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করছেন। একতা হাউজিংয়ের অটোরিকশা মেরামত মিস্ত্রি মো. ফয়েজ জানান, সন্ধ্যা নামলেই দুর্বৃত্তরা চাপাতি হাতে ঘোরাঘুরি করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ছিনতাই চক্রে ২৫-৩০ জন রয়েছে। রাতে সবাই একসঙ্গে চাপাতি, রড ও পাইপ হাতে বের হয়। সামনে যাকে পায়, কুপিয়ে সব নিয়ে নেয়। তাদের কৌশল একটু ভিন্ন। হেঁটে নয়, তারা চাপাতি হাতে দৌঁড়াতে থাকে। আতঙ্ক তৈরিতে সমানে কোপাতে থাকে। মানুষ, দোকান কিছুই বাদ দেয় না। তাদের দাপটে অনেকেই সন্ধ্যায় বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
সড়কে মানুষকে কোপানো ও ছিনতাইয়ের মতো লোমহর্ষক একাধিক ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়েছে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ২৫-৩০ দুর্বৃত্ত তুরাগ নদের ওয়াকওয়ের দিক থেকে একতা হাউজিংয়ে ঢুকে লুটপাট শেষে ফিরে যায়। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে আবারও তারা একই পথে এসে একতা হাউজিং, ঢাকা উদ্যানের ডি ব্লকের বিভিন্ন সড়কে ছিনতাই করে।
ওই রাতে ঢাকা উদ্যানের ডি ব্লকের ৪ নম্বর রোড সংলগ্ন একতা হাউজিং লোহার ফটকের পাশে নির্মাণাধীন ভবনের দারোয়ান ও দুই শ্রমিককে কুপিয়ে-পিটিয়ে পাঁচটি মোবাইল ফোন এবং নগদ ২ হাজার ১৮০ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। দারোয়ান মো. আসাদ ও রড মিস্ত্রি সাকিব পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
গতকাল ওই ভবনের অন্য মিস্ত্রিরা জানান, তারা পাঁচজন ভবনের নিচ তলায় ছিলেন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে প্রথমবার ২৫-৩০ জন চাপাতি হাতে ভবনে ঢুকে আসাদ ও শাকিলের কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। পরে রাত সাড়ে ১০টায় আবারও এসে কিছু না বলেই কোপানো শুরু করে। জুয়েল ও হৃদয় বলেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়।
ঢাকা উদ্যানে রাজ ভ্যারাইটিজের কর্ণধার মিজানুর রহমানের ভাতিজা মাসুদ রানা জানান, শুক্রবার রাতে চাচার দোকানের গ্লাস ভেঙে ক্যাশ থেকে প্রায় ২০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। আশপাশের দোকানেও হামলা হয়েছে। পাশেই পান-সুপারি দোকানি আব্দুল মোমেন জানান, দুর্বৃত্তদের দেখেই দোকান বন্ধ করে দেন তিনি। দোকানের বাইরে থাকা ১৫ বছরের ছেলে সাবিদ আহমেদের গলায় চাপাতি ধরে তারা। সাবিদ জানায়, গলায় চাপাতি ধরে চিৎকার করতে নিষেধ করে।
২২ অক্টোবর সকালে একাদশ শ্রেণির ছাত্র রিমন হোসেন একতা হাউজিংয়ে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন। প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হলে ছয়-সাতজনকে চাপাতি হাতে আসতে দেখি। দু’দিন আগে ২০ অক্টোবর নবোদয় হাউজিংয়ের বি ব্লকে এক তরুণী ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন। পাঁচ-ছয়জন ঘিরে ধরে তাঁর ব্যাগ টানাহেঁচড়ার দৃশ্য ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান জানান, ছিনতাই ও হামলার ঘটনায় জড়িত চারজনের নাম পেয়ে মামলা করেছেন তারা। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ রুহুল কবীর খান সমকালকে জানান, দুর্বৃত্তদের ধরতে তারা কাজ করছেন। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে কয়েকজন শনাক্ত হয়েছেন। স্থানীয়দের নিয়ে ছিনতাই প্রতিরোধ করা হবে।
এদিকে ঢাকা উদ্যান, নবোদয় হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং ও বছিলাসহ মোহাম্মদপুর এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় যৌথ বাহিনী আরও ৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
র্যাব-২-এর সিনিয়র এসপি করিম সমকালকে এ তথ্য জানান। বছিলা হাউজিংয়ে গত শুক্রবার মিনি সুপারশপে ডাকাতির ঘটনায় প্রধান আসামি আসলাম ওরফে রুবেল ওরফে আলমকে গতকাল গ্রেপ্তার করেছে যৌথ বাহিনী।