বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট জেলা ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের এক মহাসম্ভার। এর মধ্যে ষাটগম্বুজ মসজিদ শুধু দেশের নয়, বিশ্বের ঐতিহ্যের অমূল্য নিদর্শন। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত এই মসজিদটি ১৫ শতকে মহান যোদ্ধা ও সমাজসংস্কারক খান জাহান আলী (র.) নির্মাণ করেন। মসজিদটি তার অনন্য নির্মাণশৈলী এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
সম্প্রতি ঘুরে এলাম বাগেরহাটের প্রাচীন নিদর্শন ষাটগম্বুজ মসজিদ। এখনো দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। ইট-পাথরের অনন্য স্থাপত্য যেন ক্লান্ত পথিককেও হাতছানি দিয়ে ডাকে। এ মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়; ইতিহাসের এক নীরব কথক। এর প্রতিটি স্তম্ভ, প্রতিটি গম্বুজে যেন লুকিয়ে আছে অতীতের গৌরবগাথা।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ধারণা করা হয় তিনি ১৫শ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদটি নির্মাণের সঠিক সময়কাল ১৪৫৯ সালের কাছাকাছি বলে ধারণা করা হয়। খান জাহান আলী সে সময় বাংলার দক্ষিণাঞ্চলকে ইসলাম ধর্মের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন।
মসজিদটির গায়ে কোনো শিলালিপি নেই তাই এটি ঠিক কোন সময়কালে নির্মাণ করা হয়েছিলো তার সুনিদ্রিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখলে এটি যে খান জাহানই তৈরী করেছিলেন সে সম্পর্কে মোটামুটি একমত হওয়া যায়।
মসজিদটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উপাসনালয় ছিল না; এটি ছিল প্রশাসনিক ও সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্র। মসজিদের ইট ও পাথরের কাঠামো, অসাধারণ খোদাই কাজ ও গম্বুজের বিন্যাস এর স্থাপত্যকলায় এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছে।
মসজিদের বিবরণ ও নামকরণ
মসজিদটি ষাটগম্বুজ নামে পরিচিত হলেও এতে মোট গম্বুজ আছে ৮১টি। মসজিদের চার কোনের মিনার বা বুরুজের ওপরের ৪টি গম্বুজ বাদ দিলে গম্বুজের সংখ্যা ৭৭। এর মধ্যে ৭০টি গম্বুজের উপরিভাগ গোলাকার এবং মসজিদের মাঝ-বরাবর গোলাকার গম্বুজগুলোকে ৭টি চার কোনাবিশিষ্ট গম্বুজ দিয়ে সংযোগ করা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব কোনের বুরুজটির ভেতর দিয়ে ওপরে বা ছাদে ওঠার সিঁড়ি আছে। এর নাম ‘রওশন কোঠা। আর উত্তর-পূর্ব কোনের বুরুজটি দিয়েও ওপরে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। এর নাম আন্ধার কোঠা নামে পরিচিত।
ষাটগম্বুজ মসজিদের নামকরণের সঠিক ইতিহাস নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, সংস্কৃত শব্দ ‘সাত’ ও ফারসি শব্দ ‘ছাদ’-এর ওপর গম্বুজ থাকায় এটি ‘ছাদগম্বুজ’ থেকে ‘ষাটগম্বুজ’ হয়েছে। আবার কারও মতে, মসজিদের অভ্যন্তরে ছয়টি সারিতে ১০টি করে মোট ষাটটি পাথরের খাম্বার ওপর মসজিদের ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে বলে এর নাম হয়েছে ষাটগম্বুজ। কারও মতে, মসজিদটির ছাদ সমতল নয়। এটি গম্বুজ আকৃতির। সেই থেকে মসজিদটি ‘ছাদগম্বুজ‘ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরে কথ্যরূপে ‘ষাটগম্বুজ‘ নাম হয়েছে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে প্রথমে খুলনা যেতে হবে। সড়কপথে খুলনার দূরত্ব প্রায় ৩২০ কিলোমিটার। বাস, ট্রেন বা ব্যক্তিগত যানবাহনে খুলনা পৌঁছানো যায়। বাস ভাড়া (এসি বাস) প্রায় ১২০০ টাকা। খুলনা থেকে বাগেরহাট ৩০ কিলোমিটার দূরে, যেখানে স্থানীয় বাসে যেতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। লোকাল বাসের ভাড়া ৭০-১০০ টাকার মধ্যে।
যাওয়া-আসা ও খরচ
ঢাকা থেকে খুলনা: বাস ভাড়া (এসি): প্রায় ১২০০ টাকা
খুলনা থেকে বাগেরহাট: লোকাল বাস ভাড়া: প্রায় ৭০-১০০ টাকা
মসজিদে প্রবেশ ফি: দেশি দর্শনার্থীদের জন্য ২০ টাকা, বিদেশিদের জন্য ২০০ টাকা
খাবারের জন্য স্থানীয় রেস্টুরেন্টে প্রতিজনের জন্য ২০০-৫০০ টাকা খরচ হতে পারে।
আরো যা দেখতে পারেন
বাগেরহাটে খানজাহানের আমলে নির্মিত অন্য সব স্থাপনার মধ্যে রয়েছে এক গম্বুজ মসজিদ, নয় গম্বুজ মসজিদ, দশ গম্বুজ মসজিদ, রণ বিজয়পুর মসজিদ, রেজা খোদা মসজিদ, জিন্দা পীরের মসজিদ, খান জাহান আলী (রহ.)-এর সমাধি, পীর আলী তাহেরের সমাধি, জিন্দা পীরের সমাধি, সাবেক ডাঙ্গা প্রার্থনা কক্ষ, খান জাহান আলী (রহ.)-এর বসতভিটা, বড় আদিনা ডিবি, খান জাহানের তৈরি প্রাচীন রাস্তা।
ষোড়শ শতাব্দীতে খানজাহান আমলে নির্মিত ইসলামী স্থাপত্যরীতির এসব মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৮৫ সালে বাগেরহাটকে ঐতিহাসিক মসজিদের শহর হিসেবে ঘোষণা এবং ৩২১তম বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে ইউনেসকো।
ষাটগম্বুজ মসজিদের মতো ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা আমাদের জাতীয় সম্পদ। এর সংরক্ষণে আমরা সবাই ভূমিকা রাখতে পারি। প্রথমত, সেখানে ভ্রমণের সময় পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। দেয়ালে আঁকিবুঁকি বা ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও পর্যটন বিভাগকে আরও কার্যকরি উদ্যোগ নিতে হবে যাতে পর্যটকদের জন্য সুশৃঙ্খল পরিবেশ নিশ্চিত হয়।
পর্যটকদের মধ্যে ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাইলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঐতিহ্যের গুরুত্ব তুলে ধরতে পারি, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করে তুলবে।
ষাটগম্বুজ মসজিদ কেবল একটি ধর্মীয় স্থাপত্য নয়; এটি বাংলার অতীত গৌরবের স্মারক। এর নির্মাণশৈলী, ইতিহাস এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ মুগ্ধ করে সবাইকে। ইতিহাসের এই মহামূল্যবান নিদর্শন আমাদের সকলের যতেœ সংরক্ষিত থাকুক, এটাই প্রত্যাশা।
সাকিবুর রহমান
শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক