পৃথিবীর একাধিক ধর্ম এবং পৌরাণিক কাহিনীতে হজরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। এ ঘটনা কোথায়, কীভাবে ঘটেছিল, তা যদি বের করা যায়, তবে কেমন হয়?
হাজার হাজার বছর আগে হয়ে যাওয়া এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন মোটেই সহজ কথা নয়। এ রহস্যেরই পেছনে ছুটেছেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের অ্যালবার্ট লিন।
‘লস্ট সিটিজ উইদ অ্যালবার্ট লিন’- এই সিরিজের একটি অধ্যায় হলো ‘অরিজিনস অব দ্যা গ্রেট ফ্লাড।’ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত দুটি মহাপ্লাবনের রহস্য উদঘাটন করতে তিনি চষে বেড়িয়েছেন বুলগেরিয়া ও পেরুতে।
অ্যালবার্ট লিন দর্শকদের প্রথমেই নিয়ে যান বুলগেরিয়ার ডেড সি বা মৃত সাগরের তীরে। সাগর বলা হলেও আসলে তা চারদিকে ভূমি দিয়ে ঘেরা এক লাখ ৭০ হাজার বর্গমাইলের এক সুবিশাল জলাশয়। অনেকের বিশ্বাস, বৃহৎ এই জলাধার ঘিরেই প্রচলিত হজরত নূহ (আ.)-এর সেই মহাপ্লাবনের কাহিনী।
পৌরাণিক কাহিনীতে বলা হয়েছে, ৪০ দিন ও ৪০ রাত্রের সেই মহাপ্লাবনে টিকে থাকতে অতিকায় এক নৌকা তৈরি করা হয়, এতে তুলে নেওয়া হয় পৃথিবীর সব ধরনের প্রাণীর একটি করে জোড়া। এরপর যে মহাপ্লাবন আসে, এতে বাকি সব প্রাণী ডুবে মারা যায়।
ইতিহাসে এমন কী ঘটনা আছে, যার সঙ্গে এই মহাপ্লাবনের মিল আছে? তা খুঁজতে যুগ যুগ ধরে হন্য হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গবেষণা চালিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। কিন্তু ১৯৯০ সালের দিকে গবেষকরা নতুন এক তথ্য পেয়ে যান। তারা মধ্যপ্রাচ্যে খোঁজাখুঁজি বদলে বুলগেরিয়ার দিকে চলে আসে।
ইতিহাস থেকে দেখা যায়, সবশেষ বরফ যুগের পর প্রচুর বরফ গলার কারণে ভূমধ্যসাগর উপচে পড়ে এবং মৃত সাগরের পরিধি বাড়িয়ে দেয় অনেকগুণে। এ ঘটনা থেকেই ওই মহাপ্লাবনের ধারণা আসতে পারে।
বুলগেরিয়ার স্থানীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. ক্রিস্টো স্মোলানফ বলেন, তারা মৃত সাগরের নিচে হারানো এক সভ্যতার প্রমাণ পান। তারা সেখান থেকে পৃথিবীর প্রাচীনতম সোনার খোঁজ পান, যা ‘কসমিক গোল্ড’ নামে পরিচিত। যেটি প্রায় ৭০০০ হাজার বছরের পুরনো। তারা এরকম কসমিক গোল্ডের ৩১২টি দ্রব্যসামগ্রী আবিষ্কার করতে সক্ষম হন, যেটিতে প্রায় ১৩ পাউন্ডের সোনা রয়েছে।
এরপর পেরুতে সংঘটিত হওয়া আরেক মহাপ্লাবনের খোঁজ পাওয়া যায়। মানব ইতিহাদের সবচেয়ে ভয়ংকর বলিদানের রহস্যের খোঁজে বুলগেরিয়া থেকে পেরুতে পাড়ি দেন অ্যালবার্ট লিন। দেশটির প্রশান্ত মহাসাগরের এই মহাপ্লাবন সম্পর্কে বাইবেলেও উল্লেখ রয়েছে। হজরত নূহ (আ.)-এর মত বিশেষ কিছু অনুসারীরাই এই দুর্যোগে টিকতে পেরেছিলো।
পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, একটি লামা (দক্ষিণ আমেরিকার উটজাতীয় একটি গৃহপালিত প্রাণী) ভয়ঙ্কর এক মহাপ্লাবন নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল। ওই লামাটি মানুষের মতো কথা বলতে জানতো। তাই, সে স্বপ্ন দেখে, তার মালিকসহ বিভিন্ন পশুদের সতর্ক করে। ওই লামার সতর্কবার্তা যারা শুনেছিল, শুধু তারাই এই যাত্রায় বেঁচে যায়। এভাবেই চিমু সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়।
এরপর অ্যালবার্ট লিন চলে যান চিমু সভ্যতার কেন্দ্রস্থলের কাছে ত্রুজিলো শহরে। ত্রুজিলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ ফেরেন কাস্টিলোর কাছ থেকে জানতে পারেন, এ শহরের এক নির্মম বলিদানের ঘটনা সম্বন্ধে, যা ১৪৫০ সালের দিকে ঘটে।
পেরুর উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৫৫০ বছর আগে এক দফায় ১৪০ জনের বেশি শিশুকে দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়। শুধু এই শিশুদেরই নয়, তাদের সঙ্গে ২০০-র বেশি লামাকেও বধ করা হয়।
সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরোনো মন্দিরে খননকাজের সময় বলির শিকার ৪০ জনের হাড়গোড় ও ৭৪টি লামার দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। লামাগুলোর বয়স ছিল ১৮ মাসেরও কম। এদের আন্দিজ পর্বতমালার দিকে মুখ করে কবর দেওয়া হয়। মন্দিরটি ওয়ানচাকিতো-লাস-ইয়ামাস নামে পরিচিত।
ফেরেন কাস্টিলো জানান, বলি দেওয়া ১৪০ জন শিশুকে। তাদের বয়স ছিল ৫ থেকে ১৪ বছর। তবে বেশির ভাগেরই বয়স ছিল ৮ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। শিশুদের হাড় কেটে ফেলার চিহ্ন, বুকের পাঁজর ও হাড় দেখে তাদের শনাক্ত করা হয়। অনেকের পাঁজর ভাঙা ছিল। এতে মনে করা হচ্ছে, এই শিশুদের হৃৎপিণ্ড খুলে নেওয়া হয়েছিল। মূলত খরাপীড়িত এই এলাকায় বৃষ্টি ও বন্যার আশায় এই উৎসর্গ করা হয়েছিল।