আলি আবরার
ভারতের মিডিয়া, যেটি সাধারণত গরু, মঙ্গলযান আর বলিউড নিয়ে মেতে থাকে, বাংলাদেশ নিয়ে কথা উঠলে যেন পুরোপুরি ভিন্ন মেজাজে চলে যায়। তাদের মতে, বাংলাদেশ শুধু ভারতের ছোট প্রতিবেশী দেশ নয়, বরং একটি ‘জাতীয় বিপদ’ যা যে কোনো মুহূর্তে ভারতকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। আর সেই উত্তেজনা ছড়াতে তারা কল্পনার এমন এক জগৎ সৃষ্টি করে যে, বাংলাদেশের মানুষ নিজেরাই মাঝে মাঝে দ্বিধায় পড়ে যায়—আমরা কি আসলেই এত বড় হুমকি?
১. অর্থনীতি: ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন কি ভারতের জন্য বিপদ?’
বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিক অগ্রগতির রাস্তায় এগিয়ে যাচ্ছে, ভারতের মিডিয়া তখন সেটিকে একেবারে যুদ্ধ পরিস্থিতি হিসেবে দেখায়। শিরোনামে আসে—
“বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বাড়ছে, ভারত কি চাপে পড়বে?”
“বিশ্বব্যাংকের প্রশংসা পেল বাংলাদেশ, ভারত কি পিছিয়ে যাচ্ছে?”
বিশেষজ্ঞরা টিভিতে বসে বিশ্লেষণ করেন, “বাংলাদেশের পোশাক খাতের সাফল্য ভারতের ক্ষতি করছে। এটা কি চীনের দ্বারা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র?” এমনকি তারা অভিযোগ তোলে, “বাংলাদেশি পণ্য ভারতীয় বাজারে ঢুকে আমাদের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ধ্বংস করছে।”
কিন্তু যখন ভারতের কোনো অর্থনৈতিক অর্জন হয়, তখন সেটি অবশ্যই “বাংলাদেশের জন্য উদাহরণ।” দ্বিমুখী এই মনোভাব ভারতের মিডিয়াকে এমন এক মজার চরিত্রে পরিণত করেছে, যাকে কেউ আর সিরিয়াসলি নেয় না।
২. অভিবাসন: ‘বাংলাদেশিরা আমাদের দখল করছে!’
বাংলাদেশ থেকে ভারতে অভিবাসন একটি পুরনো ইস্যু, কিন্তু ভারতের মিডিয়া সেটিকে প্রতিবার নতুন গল্পে রূপান্তর করে। খবর আসে—
“বাংলাদেশি অভিবাসীরা আসছে, ভারতের কাজ দখল করছে।”
“অসমে জনসংখ্যা বাড়ছে, বাংলাদেশিদের জন্য সংকট তৈরি হচ্ছে।”
একটি সাধারণ অভিবাসন সমস্যা নিয়ে এমন ভয়ঙ্কর গল্প বানানো হয়, যেন পুরো ভারত বাংলাদেশের হাতে চলে যাচ্ছে। এরপরে সেই গল্প রাজনৈতিক মঞ্চে ছড়িয়ে পড়ে, আর টিভির পর্দায় ‘জ্বালাময়ী আলোচনা’ হয়।
৩. ক্রিকেট: ‘বাংলাদেশের জয়, ভারতের জন্য অপমান!’
বাংলাদেশ যখনই ভারতের বিরুদ্ধে ক্রিকেট ম্যাচ জেতে, সেটি যেন ভারতীয় মিডিয়ার জাতীয় মর্যাদার ওপর আঘাত। তখন সংবাদ শিরোনাম হয়—
“বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের অশ্রদ্ধা, ভারতের জন্য লজ্জা।”
“বাংলাদেশের এই আত্মবিশ্বাস কি চীনের সহায়তায় এসেছে?”
তারা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের প্রত্যেকটি পদক্ষেপকে এমনভাবে বিশ্লেষণ করে, যেন এটি একটি কৌশলগত হামলা। “শাকিব আল হাসান কেন এমন আক্রমণাত্মক খেলছেন?” বা “তাসকিনের বাউন্সারে ভারতীয় ব্যাটসম্যানের অসুবিধা কি ইচ্ছাকৃত?”—এসব প্রশ্ন নিয়েই তারা দিনরাত ব্যস্ত থাকে।
৪. সংস্কৃতি: ‘বাংলাদেশ ভারতের ঐতিহ্য চুরি করছে!’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জামদানি শাড়ি, ইলিশ মাছ, এমনকি পান্তাভাত—সবকিছুতেই ভারতের মিডিয়া বাংলাদেশকে চুরির দোষারোপ করে। শিরোনাম হয়—
“জামদানি ভারতের ঐতিহ্য, বাংলাদেশ কেন দাবি করছে?”
“পান্তাভাত উৎসব? এটি তো বাংলার অংশ, বাংলাদেশ আলাদা করে কেন করছে?”
যখন বাংলাদেশ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায়, তখন ভারতের মিডিয়া সেটিকে নিজেদের ‘জাতীয় ক্ষতি’ হিসেবে দেখে। তারা এমন গল্প বানায়, যেন বাংলাদেশের কৃতিত্ব ভারতের জন্য কোনো ষড়যন্ত্রের ফলাফল।
৫. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: ‘বাংলাদেশ কি ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে?’
বাংলাদেশ যখন চীনের সঙ্গে কোনো অর্থনৈতিক বা কূটনৈতিক চুক্তি করে, তখন ভারতের মিডিয়া সেটিকে বিশ্ব রাজনীতির সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দেখায়। শিরোনাম—
“বাংলাদেশ চীনের পাশে দাঁড়াচ্ছে, ভারতের নিরাপত্তা বিপন্ন।”
“চীনের সাহায্যে বাংলাদেশ বন্দর উন্নয়ন করছে, এটি কি ভারতের জন্য হুমকি?”
তারা এসব নিয়ে এমন তত্ত্ব তৈরি করে, যেন বাংলাদেশের প্রধান উদ্দেশ্য ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা। কিন্তু বাস্তবে, এটি শুধুই একটি উন্নয়নশীল দেশের নিজের অর্থনীতির উন্নতি করার প্রচেষ্টা।
৬. রোহিঙ্গা সংকট: ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ কি ভারতকে বিপদে ফেলছে?’
বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা করার জন্য যখন বিশ্বব্যাপী প্রশংসা পায়, তখন ভারতের মিডিয়া এটি নিয়ে বলছে—
“বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা ভারতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”
তারা এমন একটি চিত্র তৈরি করে, যেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার জন্য ভারতেই দায়ী হয়ে যাবে। অথচ বাংলাদেশ একাই এই সংকট সামলানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
উপসংহার: বাংলাদেশের সাফল্য, ভারতের মিডিয়ার দুঃস্বপ্ন
বাংলাদেশের প্রতিটি অগ্রগতি ভারতের মিডিয়ার জন্য একটি অশনি সংকেত। তারা বাংলাদেশের প্রতিটি অর্জনকে একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখায় এবং নিজেদের দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। তবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এই সব নাটকীয় খবর দেখে শুধু মজা পায়।
ভারতের মিডিয়ার এই অদ্ভুত আচরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রতিবেশীর অগ্রগতিকে সম্মান না করে, তাকে হেয় করার চেষ্টা করাই তাদের কাজ। তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের সাফল্য তাদের জন্য মাথাব্যথা হলেও, এটি আসলে বাংলাদেশের প্রমাণ যে, তারা সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে।