একটা সময় ছিল আমরা পরিবারের সাথে বসে একসঙ্গে টেলিভিশন দেখতাম। আমাদের বাবা-মায়েরাও তাদের বাবা-মাসহ পুরো পরিবারের সাথে একসঙ্গে টেলিভিশন দেখতেন। ঐসময়ে বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল টেলিভিশন। মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে সেদিনগুলোতে। সপ্তাহে একদিন শুক্রবার বিটিভে (পরবর্তীতে সবগুলো চ্যানেলে) বাংলা সিনেমা দেখার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে সবাই সিনেমা দেখত। তখন টেলিভিশনগুলোতে ধারাবাহিক নাটক চলতো। শিশুদের জন্য সপ্তাহে একদিন সিসিমপুর অনুষ্ঠান হতো। সবকিছুতেই একটা বাঙ্গালীত্ব ভাব ছিল। বাঙালির হাজার বছরের চলন-বলন, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি ফুটে উঠত নাটক-সিনেমা ও অনুষ্ঠানগুলোতে।
আজ যুগের পরিবর্তন হয়েছে। দেশ আধুনিকায়ন হয়েছে। বাংলাদেশ আজ ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছে। বর্তমানে বিনোদনের টেলিভিশনের জায়গা দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি)।
এভাবে বিশ্বের সঙ্গে মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, বিষয়টি ভালো। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটছে বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ, এসবে এখন বাঙালিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
এ যুগে ইউটিউব ও ফেসবুকের ব্লগ বা কনটেন্টকে সবাই বিনোদন হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্তু এসব ব্লগ বা কনটেন্ট ভিডিওগুলো দিন দিন খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে। এসবে নেই কোনো শিক্ষামূলক প্রচারণা কিংবা আদব কায়দার বালাই। অপসংস্কৃতি ও অসামাজিক কার্যকলাপ চর্চার উন্মুক্ত প্লাটফর্ম যেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
তবে, এটা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। অনেকেই ভালো মানের ও শিক্ষণীয় কনটেন্ট তৈরি করেন। তারা দেশীয়-আন্তর্জাতিক মানের ও তথ্যনির্ভর কনটেন্ট তৈরি করছেন। কিন্তু, স্মার্ট চিন্তা কিংবা সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে খুব কম মানুষই কন্টেন্ট বানাচ্ছেন।
ভাইরাল হওয়ার চিন্তায় মগ্ন এ সমাজ। সবার মধ্যে লাইক, কমেন্ট, সাবস্ক্রাইভ আর ভিউয়ার্স বাড়ানোর এক নেশা। এ নেশায় যে যেভাবে পারছে সেভাবে মানুষকে বিনোদনের নাম করে যা ইচ্ছে তাই ভিডিও বানিয়ে আপলোড করছে। ভিনদেশের অসুস্থ সংস্কৃতিকে টেনে এনে বিকৃত অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে অপবিনোদন এ সমাজের মস্তিষ্ক নষ্ট করছে।
ভিউয়ার্স বাড়ানোর চিন্তায় ব্লগের নামে যেখানে সেখানে ভিডিও করে মানুষকে ভিডিওর ফ্রেমে এনে, প্রশ্ন করে কিংবা প্রাঙ্ক করে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে অনেকে। বিশেষ করে উড়তি (বাড়ন্ত) বয়সের ছেলেমেয়েরা এসব কাজ বেশি করছে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন গানের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার করে ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে বিচ্ছিরি মানের কনটেন্ট তৈরি করছে তারা।
এসব কনটেন্ট একজন রুচিবোধ সম্পন্ন মানুষ কখনো স্বাভাবিক অবস্থায় দেখতে পারেন না। সামাজিক মূল্যবোধ হারানোর ফলে ছেলেমেয়েরা এ ধরনের ভিডিও কনটেন্ট বানাতে সময় অপচয় করছে।
ভিডিও কনটেন্ট বানাতে গিয়ে অনেকেই জড়িয়ে পড়ছেন নানা অপকর্মে। কেউ কেউ টিকটক, ইউটিউব ও ফেসবুকে তাদের কন্টেন্টের মডেল বানানোর ও কাজ শেখানোর কথা বলে আড়ালে নারী পাচার করার তথ্যও সংবাদ মাধ্যমে উঠে এসেছে। আবার কেউ দেখি নিজেকে গায়ক প্রমাণ করতে গিয়ে রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীতের একবারে শ্রাদ্ধ করে ফেলছেন।
এসব ভিডিও পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, কেউই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নয়। নেই অনলাইন দুনিয়ার সামাজিকতার ব্যাপারে জ্ঞান। শুধু অমুক ভিডিও করেছে, তার পরিচিতি বেড়েছে। সে কন্টেন্ট বানিয়ে টাকা আয় করছে। আমিও অমুকের মতো জনপ্রিয় হব, আমিও টাকা ইনকাম করব। শুরু হয়ে গেলো অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
মাথায় যা আসে, বুঝে না বুঝে তা নিয়েই ভিডিও করে আপলোড করছে। মানুষ তার ভিডিও পছন্দ করছে না। বিচ্ছিরি ভিডিও দেখে কেউ হাহা রিয়েক্ট দিচ্ছে আবার কেউ রেগে অ্যাংরি রিয়েক্ট দিচ্ছে। তার কন্টেন্ট নিয়ে মানুষ নানা সমালোচনা করছে। কিন্তু তাতে তার কি? আলোচনা সমালোচনা করার ফলে তো সে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। তার ভিডিওর মিলিয়ন ভিউয়ার্স হচ্ছে, এটাই তার লাভ। কারণ ভিউয়ার্স বাড়ার সাথে সাথে তার একাউন্টে ডলার যোগ হচ্ছে।
যেতে যেতে আমরা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি অন্যের শোবার ঘর পর্যন্ত উঁকি মারতে শুরু করেছি। মানে নিজেরা শোবার ঘরে কে কি করছি, সেটাও ভিডিও করে আপলোড করছি। আর আমরাও সেটা দেখছি। না দেখেইবা উপায় কী? ফেসবুক ও ইউটিউব স্ক্রল করার সময় অটোমেটিকই এসব ভিডিও সামনে চলে আসে।
বিনোদন আমাদের আনন্দ দেয়। এই আনন্দ আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে আরও উজ্জীবিত করে। হাসি, কান্না, প্রেম, ভালোবাসা সবকিছুর মিশ্রণ থাকে বিনোদনে। কিন্তু সেই বিনোদন যেন আমাদেরকে অসুস্থ সমাজের দিকে ধাবিত না করে। সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষার্থে ভাইরাল হওয়ার এসব অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ হোক।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণমাধ্যম কর্মী