অশীতিপর দুধ বিক্রেতা সুলতান মীরের জীবনের গল্প
আসাদুজ্জামান মিলন, শরণখোলা থেকে
বয়সের ভারে যেনো নুয়ে পড়েছে শরীর । রোদে পুড়ে অনেকটা বিবর্ণ হয়ে কুচকে গেছে গায়ের চামড়া। শরীরে আগের মতো শক্তি নাই। অভাব অনটন তার উপর বার্ধক্যের শরীরে নানা রোগ ব্যাধির ভার যেনো তাকে থামিয়ে দিতে চাইছে । তবু ও ভাড়ি বোঝা নিয়ে পথ চলে দুধ বিক্রেতা সুলতান মীর (৮৫)। অবশ্য চলতে হয়, জীবনের নিয়মে।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রবন শরণখোলা উপজেলার কদমতলা গ্রামের মৌলভী বাড়ি এলাকায় তার বসবাস। এখানে একটি ছোট একখন্ড জমিতে একটি ভাঙ্গা ঘরে স্ত্রী ফিরোজা বেগম কে নিয়ে জীবন যুদ্ধ করে চলছেন অশীতিপর বৃদ্ধ সুলতান মীর । সকাল হলে আশে পাশের কয়েকটি গ্রামের গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরুর দুধ কিনে তা নিয়ে যান উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজারে। বাজারের হোটেল রেস্তোরা আর কয়েকটি বাসা বাড়িতে এ দুধ বিক্রি করে সামান্য যা আয় হয় তা দিয়ে চলে
দু’জনার সংসার। জীবনের শুরুতে হাল চাষ আর সাংসারিক কাজ করতেন সুলতান মীর। ধীরে ধীরে শরীরে শক্তি কমে আসায় গত ১৪/১৫ ধরে দুধ কেনা বেচার কাজ করছেন সে। শুরুতে বড় বড় কলসী ভরে দুধ কেনা বেচা করে মোটামুটি রোজগার হত । এখন আগের মত বড় কলসী বহন করতে পারেনা । এখন বাজারের ব্যাগে করে প্লাষ্টিকের জারে দুধ আনেন তিনি । তাই আগে কলসীতে ৩০/৪০ কেজি দুধ বহন করতে পারলেও এখন আর ১৫/২০ কেজি দুধ বহন করতে পারেন না। কাক ডাকা ভোরে গ্রামের গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরুর দুধ কিনে নিয়ে যান রায়েন্দা বাজারে। গৃহস্থের বাড়ি থেকে প্রতি কেজি দুধ ৬০ থেকে ৭০ টাকায় কিনে বাজারে ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। ১৫ / ২০ কেজি দুধ বিক্রি করে তার ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় আয় হয়। কদমতলা থেকে রায়েন্দা আসা যাওয়ায় ৪০ থেকে ৫০ টাকা ভ্যান ভাড়া দিতে হয় । তাই মাঝে মধ্যে পায়ে হেটে চলতে থাকেন জীবনযুদ্ধের পরিশ্রমী এ পরিশ্রমী যোদ্ধা সুলতান মীর।
কয়েক দিন আগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসেন সে। কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেয়। উত্তরে কষ্টমাখা সে মুখে ছোট্ট এক চিলতে হাসি দিয়ে বলেন, ”ঔষধ লেইখ্যা দেন । হাসপাতালে হুইয়া থাকলে, সংসার চলবেনা। লগে যে দুধ লইয়া আইছি, ব্যাচতে না পারলে সব শ্যাষ।”
হাসপাতালেই তার কুশল বিনিময়ের পর কেমন আছেন, জানতে চাইলে বৃদ্ধ সুলতান মীর আলাপচারিতায় তার জীবনের এ গল্প তুলে ধরেন। ছেলে সন্তানরা কি করেন, জানতে চাইলে জানান, একমাত্র ছেলে ইউসুফ মীর পান সিগারেট এর দোকান দিতেন। দুই বছর আগে ধার দেনা করে সৌদি আরব গেছেন। এতে আট লাখ টাকার মত খরচ হয়েছে । এখন ও ধার দেনা পরিশোধ করতে পারেনি বলে জানান তিনি। ধারদেনা শোধ হলে তার কষ্টের দিন শেষ হবে । জীবন সায়াহ্নে এমন স্বপ্ন দেখছেন সুলতান মীর।
কোন সরকারি সাহায্য পান কি না জানতে চাইলে সুলতান মীর জানায়, ” হয়, মুই বয়স্ক ভাতা পাই। মাসে ৬০০ টাহা । তিন মাস, ছয়মাস পর পর টাহা তুলি। দুধ ব্যাচা লাভের টাহা আর বয়স্ক ভাতার টাহা মিলাইয়া ঝিলাইয়া সংসার চালাই। তয়, বয়স্ক ভাতার টাহাডা একটু বাড়াইয়া, মাসের টাহা মাসে দেলে, মোগো নাহান মানুষের আরো উপকার অইতো।”