তাজিকিস্তানের রাজধানী শহর দুশানবে থেকে রওনা করেছি, গন্তব্য উজবেকিস্তানের বর্ডার জর্তেপা। দুশানবে শহর থেকে এই বর্ডারের দূরত্ব তিন শ কিলোমিটার। জর্তেপা বর্ডারে উজবেক গাইড আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সেখানে দুপুর ১টায় পৌঁছার কথা আমার।
পথিমধ্যে কিছু স্থানে বিরতি নেওয়ায় সামান্য দেরি হলো। তাজিক গাইড হুসেনের কাছে বিদায় নিয়ে উজবেক মাটিতে পা রাখলাম। সীমান্তের সব কাজ সেরে সামনে এগিয়ে উজবেক গাইডকে খুঁজছি। অল্প সময় পরেই একজন এসে পরিচয় দিল।
নাম আযহার। গাইড আযহার ২৩-২৪ বছরের টগবগে এক তরুণ। মধ্য এশিয়ার সীমান্তগুলো পার হওয়ার বিষয়ে না বলে পারছি না। একেবারে বিনা বাক্য ব্যয়ে পার হওয়া যাকে বলে।
আসলে কাগজপত্র আর পাসপোর্ট ঠিক থাকলে অযথা ঝামেলা হয় না। পূর্ব আফ্রিকায়ও তাই দেখেছি।
মধ্য এশিয়ার পর্যটনশিল্প দারুণভাবে গড়ে উঠছে। আযহার ভাঙা ভাঙা শব্দে ইংরেজি বলে। আমার খাওয়ার পানি ফুরিয়ে গেছে।
আযহারকে পানির কথা বলতেই গাড়ি থামিয়ে এক বোতল ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এলো। ঘড়িতে সময় দেখলাম বিকেল ৪টা। যাব উজবেক সীমান্ত থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে শাখরিসাবজ শহরে। গ্রীষ্মের এ সময়টাতে মধ্য এশিয়ার দিনগুলো হয় ১৫-১৬ ঘণ্টার। যদিও তাপমাত্রার কারণে ভ্রমণ একটু কষ্টকর ঠেকে। দুই ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে পৌঁছাতে। আযহার আশ্বস্ত করল, সময়মতোই আমরা কাজ সারতে পারব। আযহার কথা বলছে কিন্তু আমি পথ দেখছি—কী মায়াময়, পাহাড়ঘেরা। একবার উঁচুতে উঠছি, আবার নামছি।
উজবেক ভ্রমণে আগেও এসেছি। তবে এই ঐতিহাসিক শহরটি দেখা হয়নি। তাই তাজিকিস্তান থেকে সীমান্ত পথে সমরখন্দ আসার পরিকল্পনা করেছি শুধু বিশ্ব বিজেতার জন্মস্থান দেখার জন্য। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝেছেন উজবেকিস্তানের কোন বিশ্ব বিজেতার কথা বলছি। তিনি তৈমুর বিন তারাঘাই বারলাস। তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তৈমুর লং নামেই বেশি সমাদৃত।
বেলা প্রায় পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। এ রকম সময়ে তৈমুরের জন্মস্থানে এসে পৌঁছালাম। বিশাল কমপ্লেক্স। চারদিকে সবুজের সমারোহ। চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে তৈমুর লং, মানে তাঁর ভাস্কর্য। কিছুদূর হেঁটে যাবার পর চোখে পড়ল। ভাস্কর্যের পেছনেই দেখছি আক সাই প্রাসাদ। চৌদ্দ শতকের প্রাসাদ ও কেল্লার ধ্বংসাবশেষ, ভীষণ ভালো লাগছে। ধ্বংসাবশেষই যদি এত ভালো লাগে, তবে সে সময়ের কথা আমার কল্পনারও অতীত। আরো ভালো লাগছে তৈমুর লং-এর নতুন ভাস্কর্য দেখে। পুরো উজবেকিস্তানে তৈমুর লংয়ের কয়টি ভাস্কর্য আছে আমি জানি না। তবে দুবার ভ্রমণে এসে আমি দেখেছি তিনটি ভাস্কর্য। একটি সমরখন্দ শহরের কেন্দ্রে, একটি তাসখন্দে আর তাঁর জন্মস্থান শাখরিসাবজে আজ দেখলাম। মুহূর্তেই যাত্রার সব ধকল ভুলে গেলাম।
শাখরিসাবজ শহর সম্পর্কে একটু বলে রাখি। আগেই বলেছি এটি তৈমুর লংয়ের জন্ম শহর। এখনকার সুসজ্জিত আধুনিক চেহারা দেখে বিশ্বাস করা কঠিন যে এই শহর দুই হাজার ৭০০ বছরের পুরনো এবং একসময় এটি মধ্য এশিয়া অঞ্চলের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পূর্বে শাখরিসাবজ ছিল প্রাচীন সোগদ রাজ্যের রাজধানী এবং এর নাম ছিল কিশ। এটি ছিল সংস্কৃতি, বাণিজ্য ও হস্তশিল্পের বিখ্যাত কেন্দ্র। ৩২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট শহরটি জয় করেন এবং স্বাভাবিকভাবেই হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি এবং গ্রিক দেবতাদের ধর্ম সেখানে উপস্থিত হয়। সহস্রাব্দের বেশি সময় ধরে শাখরিসাবজ বিভিন্ন রাজবংশের অধীনে ছিল। আজ এই বিস্ময়কর শহরটি আমির তিমুরের জন্য বিখ্যাত, যিনি পার্শ্ববর্তী গ্রাম হোদজা ইলগারে জন্মগ্রহণ করেন। শাসক হয়ে তিনি শাখরিসাবজকে তার বাসভবনে পরিণত করেন এবং আক সারে (সাদা প্রাসাদ) নামে পরিচিত প্রাসাদ নির্মাণের নির্দেশ দেন। সেই সময়ে কিশের নাম পরিবর্তন করে শাখরিসাবজ রাখা হয়েছিল। ফার্সিতে যার অর্থ সবুজ শহর। এখানে আক সারে প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষই নেই, রয়েছে সমাধি কমপ্লেক্স ডোরুত তিলোভাত, মসজিদ কোক গুম্বাজ, সমাধি ডোরাস সিওদাতের ধ্বংসাবশেষ। চলতে চলতে আলেকজান্দ্রিয়া সময়ের একটি হাম্মামখানার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলাম। এটি মধ্যযুগীয় মধ্য এশিয়ার নগর পরিকল্পনা এবং স্থাপত্যের একটি আদর্শ উদাহরণ।
বিশ্ব বিজেতার জন্মস্থানে
শাখরিসাবজের বেশির ভাগ স্মৃতিস্তম্ভ তৈমুর এবং তিমুরিদের শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল। এভাবে আমির তৈমুর তাঁর জন্ম শহরটিকে দ্বিতীয় রাজধানীতে পরিণত করেছিলেন। বিলাসের ক্ষেত্রে সমরখন্দের চেয়ে কম নয়। ইতিহাসে এর গুরুত্বের কারণে শহরটি ২০০০ সালে ইউনেসকোর বিশ্বঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। বিভিন্ন গ্রন্থ এবং ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপিতে তৈমুর সম্পর্কিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লিপিবদ্ধ করা আছে। ইতিহাস বলছে তিনি ছিলেন দারুণ কৌশলী সমরনায়ক, নিষ্ঠুর শাসক। একবিংশ শতাব্দীতে বসে প্রায় হাজার বছর আগের বিশ্বরাজনীতি, জীবনযাপন, ভূখণ্ডের রীতিনীতি আসলে কতটুকুই বা অনুধাবন করা যায়। তৈমুরের ভূখণ্ড তাঁকে যেভাবে স্মরণ করছে, একজন ভ্রমণকারী হিসেবে আমার কাছে তৈমুর লং একদম সে রকম। স্থানীয় উজবেকদের কাছে তৈমুর লং একজন দারুণ যোদ্ধা। যার দারুণ একটি শিল্পমন ছিল। বিশ্বের সব দক্ষ শিল্পী ও কারিগরকে দিয়ে সমরখন্দ ও শাখরিসাবজ শহরকে পৃথিবীর রানি হিসেবে সাজিয়েছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, তৈমুর লং খোঁড়া ছিলেন। তৈমুরের পঙ্গুত্ব নিয়ে দ্বিধার অবসানের উদ্দেশ্যে ১৯৪১ সালে এক রুশ প্রত্নতাত্ত্বিক তৈমুরের সমাধিক্ষেত্র খনন করেন। গবেষণায় তৈমুরের কোমরের বেশ কিছু স্থানে হাড়ের অসারতা এবং ডান হাতে দুটি আঙুলের হাড় ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়। তৈমুরের কফিনের ঢালায় বড় করে লেখা ছিল ‘যে আমার কবর খনন করবে, সে আমার চেয়েও ভয়াবহ এক শাসককে জাগিয়ে তুলবে এবং আমি যেদিন ফের জেগে উঠব সেদিন সমগ্র পৃথিবী আমার ভয়ে কাঁপবে!’
কমপ্লেক্সে হাঁটতে হাঁটতে এসব ইতিহাসের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে ফেলেছিলাম। গাইড আযহার বলল, আমাদের ফিরতে হবে। ফেরার পথে পাহাড়ের ধারে এক রেস্তোরাঁয় বসে পাতির নান আর ভেড়ার মাংসের কাবাব খাবার পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল। আযহার জানায়, এই স্থানেই সমরখন্দের সবচেয়ে মজার নান আর ভেড়ার কাবাব তৈরি হয়।
আবারও ফিরছি পাহাড়ের স্পাইরাল পথ ধরে। অল্প আলোতে পাহাড়ের বড় বড় পাথরগুলো দেখে কেমন জানি ভয় হয়। মনে হয় অপার্থিব কোনো স্থানে এসেছি। শাখরিসাবজ শহরটি দ্য গ্রেট উজবেক হাইওয়ের ওপরে অবস্থিত। পাহাড়ি প্যাঁচানো পথ ছেড়ে গ্রেট উজবেক হাইওয়ের পথ ধরলাম। মনের ভেতর গুনগুন করছিল ইতালির পর্যটক মার্কো পোলোর ভ্রমণ গল্পে পড়া মধ্য এশিয়ার এসব প্রাচীন পথের কথা। ফিরব সমরখন্দ শহরের গেস্ট হাউসে। ছুটতে হবে আরো ১৫০ কিলোমিটার। তাজিকিস্তানের দুশানবে শহর থেকে উজবেকিস্তানের সমরখন্দ শহর আসতে সময় লেগেছে ১৫ ঘণ্টার কিছু বেশি। মানে পথিমধ্যে সব কাজ সেরে এই রকম সময় লাগল। ৬০০ কিলোমিটার জার্নিটা
কিভাবে যাবেন
যেকোনো গন্তব্যে যাওয়ার জন্য দুই মাস আগে থেকে পরিকল্পনা করি আমি। সে স্থানের ইতিহাস, দর্শনীয় স্থান, সংস্কৃতি, প্রতিটি শহরের দূরত্ব, পরিবহন, খাবার—সব কিছু সম্পর্কে সম্যক ধারণা আগেই নিয়ে নিই। এটা ভ্রমণকে আরো আনন্দদায়ক করে তোলে। উড়োজাহাজের টিকিট, ভিসা এক থেকে দেড় মাস আগে সম্পন্ন করা জরুরি। কারণ সময়ের ওপর উড়োজাহাজের টিকিটের মূল্য নির্ধারিত হয়। এক-দেড় মাস আগে টিকিটের ব্যবস্থা করলে মূল্য অনেক কম পড়ে। উজবেকিস্তানে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশিদের অনলাইনে ভিসার আবেদন করতে হয়। সাত থেকে দশ কার্যদিবসের মধ্যে ভিসা পাওয়া যায়। বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিগো এয়ার নিয়মিত যাতায়াত করে রাজধানী শহর তাসখন্দে। আগে থেকে টিকিট করে রাখলে বেশ সাশ্রয়ী হয় ভ্রমণ। আমি দুবার মধ্য এশিয়া ভ্রমণ করেছি ইন্ডিগো এয়ারে।