জামা কাপড়ের বেলায় অনেকেই বেশ সচেতন। কেউ খোঁজেন আরামদায়ক কাপড়, কেউবা খোঁজেন দামি বা জমকালো কোনো কিছু। বিশ্বের বিখ্যাত ডিজাইনারদের তৈরি পোশাক কিনতে লাখ লাখ টাকা খরচ করেন। তবে এসব পোশাক বানাতে যে সব সময় খুব দামি কাপড় ব্যবহার হয় তা কিছু নয়, পোশাকের দাম নির্ভর করে পোশাকের কাপড়, তৈরির মুজুরি এবং আনুষাঙ্গিক আরও অনেক কিছুতে।
তবে জানেন কি বিশ্বের সবচেয়ে দামি কাপড়ের মূল্য কত? কীভাবে তৈরি হয় এটি? এবং কেনইবা এতো বেশি দাম এই কাপড়ের? চলুন জেনে নেওয়া যাক সেসব প্রশ্নের উত্তর-
পৃথিবীর সবচেয়ে দামি কাপড়ের নাম হলো ভিকুনা। এই ভিকুনা কাপড় বহু শতাব্দী ধরে রাজকীয় এবং ধনীদের পোশাকের অন্তর্ভুক্ত। তবে শুধু প্রাচীনকালেই নয়, বর্তমান সময়েও এই পোশাকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। শীতকালে গরম পোশাক থেকে এই ভিকুনা পোশাক সর্বাপেক্ষা বেশি আরামদায়ক।
এই ভিকুনা হলো, আন্দিজ পর্বতমালায় পাওয়া একটি উট, যারা বিশ্বের সবচেয়ে বিপন্ন প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। চিলি, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, পেরুতেও এই প্রাণীর দেখা মেলে। এটি অনেকটা ছাগল ও ভেড়ার মিলিত রূপের মতো দেখতে। তবে ছাগল বা ভেড়ার থেকে ভিকুনা অনেকখানি আলাদা। এদের পশম খুবই হালকা, পাতলা, সূক্ষ্ম এবং নরম হয়। সেইসঙ্গে এই পশমের তৈরি পোশাক বেশ আরামদায়কও হয়।
একটি পশমের কোট তৈরি করতে ৩৫ টি ভিকুনার থেকে উল অপসারণ করতে হয়। সেই কারণে ইতালীয় কোম্পানি লোরো পিয়ানা পেরুর আন্দিজ রেঞ্জের কাছে ৫০০০ একর জমিতে ভিকুনাদের জন্য একটি অভয়ারণ্য তৈরি করেছে। এই ইতালিয় কোম্পানি লোরো পিয়ানাই ভিকুনার পোশাক তৈরি করে থাকে।
সর্বোচ্চ মানের ভিকুনা উলের পুরুত্ব ১২-১৪ মাইক্রন। এই পশমের তৈরি পোশাকের আরামদায়কত্ব ১০০-র মধ্যে ৯৯। যা কাশ্মীরি পশমিনা ও বেবি আলপাকার থেকেও কম। কোম্পানি লোরো পিয়ানাইর ওয়েবসাইটে এই ভিকুনা দিয়ে তৈরি নানান কিছু রয়েছে। সেখানে একজোড়া মোজার দাম প্রায় ৮০ হাজার টাকা এবং শার্টের দাম প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা। সেই কারণেই ভিকুনার তৈরি পোশাককে বিশ্বের সবথেকে দামি কাপড় বলা হয়।
তবে জানেন কি? এই দুর্লভ এবং দামি কাপড়ের ব্যবহার কিন্তু শুরু হয়েছিল হাজার হাজার বছর আগে। ইনকা সভ্যতার মানুষ ব্যবহার করতেই এই পোশাক। তবে সেটা শুধুই বরাদ্দ ছিল রাজা এবং রাজপরিবারের সদস্যদের জন্যই। সাধারণ মানুষের তখন পশমের তৈরি কাপড় পরার অনুমতি ছিল না। তবে মৃত্যুর পর সাধারণ মানুষের সঙ্গে ওই পশমের পোশাকের একটা ছোট্ট টুকরো দিয়ে দেওয়া হতো। গোটা বিষয়টি খুব অদ্ভুত হলেও এটাই ঘটত ইনকা সাম্রাজ্যে। কারণ ইনকারা এই বিশেষ পশমের পোশাকটিকে ‘ঈশ্বরের কাপড়’ বলে মনে করত।
আসলে ইনকা আমলে ভিকুনাকে ঈশ্বরের দূত মনে করা হত। তাই এই প্রাণীটিকে হত্যা করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল সেসময়। কোনো ব্যক্তি যদি ভিকুনা হত্যা করত তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান ছিল। তবে কেবল রাজ পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন মতো পশম সংগ্রহ করা হত।
১৫৩২-৩৫ সালের মধ্যে স্প্যানিশরা যখন ইনকা রাজাকে পরাজিত করে ওই অঞ্চলের শাসনক্ষমতা দখল করে নেয়, তখন থেকে এই বহুমূল্য প্রাণীটির বিপত্তির শুরু। নির্বিচারে হত্যা করে ভিকুনার মাংস খেত এবং গায়ের চামড়া অধিক মূল্যে ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করত স্প্যানিশরা। প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে এর ফলে একসময় বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীতে পরিণত হয় এরা।
গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে এদের সংখ্যা মাত্র ৫ হাজারে এসে দাঁড়ায়। স্বাভাবিকভাবেই এই বহুমূল্য প্রাণীটিকে ১৯৬০ সালে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর সংরক্ষণ করার জন্য কঠোর বিধি জারি করলে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। এই মুহূর্তে বিলুপ্তপ্রায় শ্রেণির তকমা থেকে বেরিয়ে এসেছে ভিকুনা।
ভিকুনার পশম কেন এতটা মূল্যবান, জানেন কি? এই পশম থেকে তৈরি পোশাক দেহকে ঠাণ্ডার সময় দারুণ উষ্ণ রাখে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল এদের দেহে কিন্তু ভেড়ার মতো পশম তৈরি হয় না, এক বছরে মাত্র ১ পাউন্ড ওজনের পশম তৈরি হয় একটি ভিকুনার দেহে। এছাড়াও এই পোশাকগুলো বিশ্বের সবচেয়ে নরম পোশাক বলে বিবেচিত, এটাই এর চাহিদার মূল বিষয়।
একটি ভিকুনার দেহ থেকে প্রতি ৩ বছরে একবার মাত্র পশম সংগ্রহ করা যায়। মূলত স্বল্পতার কারণেই এই পশমের মূল্য এতো বেশি। এর পাশাপাশি এদের খামারে রেখে চাষ করাও সম্ভব নয়, কারণ ভিকুনারা মুক্ত অবস্থায় না থাকলে সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে না। তার ওপর দক্ষিণ আমেরিকার এই অঞ্চলের আন্দিজ পর্বতমালায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০,০০০ ফুটের বেশি উচ্চতাতেই কেবলমাত্র এই প্রাণীটিকে দেখতে পাওয়া যায়। বলতে গেলে প্রতিবছর ঠিক কতটা পরিমাণে ভিকুনার পশম সংগ্রহ করা সম্ভব হবে তা এক রকম অনিশ্চিত। এসব কারণেই এদের দেহের পশমের দাম আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।