বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক সক্রিয়তা তীব্রতর হচ্ছে এবং সারকারবিরোধী বিক্ষোভগুলো ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। বলকান অঞ্চল হিসেবে পরিচিত বসনিয়া, মন্টিনিগ্রো, উত্তর ম্যাসেডোনিয়া এবং সার্বিয়াতে বিক্ষোভ চলছে। এদিকে জর্জিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়াসহ মধ্য ও পূর্ব ইউরোপেও শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। এমনকি বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রীস, ইসরায়েল, মোজাম্বিক, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তুরস্কেও।
বিশ্বজুড়ে এমন রাজনৈতিক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল কেন? দিনশেষে এসব বিক্ষোভ গণতন্ত্রের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে কী?
বেশির ভাগ দেশে ক্ষমতাসীন সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডগুলোই বিক্ষোভ উসকে দিচ্ছে। জর্জিয়া ও মোজাম্বিকে ব্যাপক বিক্ষোভের কারণ দেশটির নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ। সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশ দুটিতে। ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ব্যাপক কারচুপি করেছে—এমন অভিযোগ তুলে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। জর্জিয়ার নতুন সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের আলোচনা স্থগিত করেছে। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমেছে মানুষ। এসব বিক্ষোভ চলছে কয়েক মাস ধরে।
এ ছাড়া অন্যান্য দেশে যেসব বিক্ষোভ চলছে, তার সঙ্গে অবশ্য নির্বাচনের সম্পর্ক নেই। যেমন, হাঙ্গিরিতে বিক্ষোভ চলছে এলজিবিটিকিউ (সমকামিতা) সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে। গত ১৮ মার্চ হাঙ্গেরির সংসদ এলজিবিটিকিউ প্রাইড মিছিল নিষিদ্ধ করে এবং নিষিদ্ধ মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের মুখাবয়ব শনাক্ত করার জন্য চীনা নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহারের অনুমতি দেয়। এরপর সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ।
ইসরায়েলে বহু দিন ধরেই থেমে থেমে নেতানিয়াহুবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। সম্প্রতি দেশটিতে বিক্ষোভ আবার দানা বেঁধেছে। গত ১৬ মার্চ ইসরায়েলের নিরাপত্তাপ্রধান রোনেন বারকে বরখাস্ত করেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এরপর নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আবারও নতুন করে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা মনে করছে, নেতানিয়াহু যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য রোনেন বারকে বরখাস্ত করেছেন। এ ছাড়া গত ১৮ মার্চ হামাসের বিরুদ্ধে নতুন করে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলাকেও পছন্দ করেনি বিক্ষোভকারীরা।
বিক্ষোভ শুরু হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়াতেও। গত ডিসেম্বরে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল হঠাৎ করেই সমারিক আইন জারি করেন। এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ। পরে প্রেসিডেন্ট সামরিক আইন প্রতাহার করে নেন বটে, তবে তাতেও বিক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। দেশটির নাগরিকেরা এখন ইউনের অভিশংনের দাবিতে বিক্ষোভ করছে।
ইস্তাম্বুলের মেয়র একরাম ইমামোগলুকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গত মার্চ থেকে তুরস্কে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। এর আগে আরেক বিরোধী নেতা আহমেত ওজারকে আটকের পর গত অক্টোবরেও বিক্ষোভ হয়েছিল তুরস্কে।
গত নভেম্বরে সার্বিয়ায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়, যার নেপথ্যে ছিল একটি ট্রেন স্টেশন নির্মাণে সরকারি দুর্নীতি। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভুসিচের পদত্যাগ দাবি করছেন।
বসনিয়ায় কয়েক মাস আগে ব্যাপক বন্যার পর সরকারি তৎপরতায় গাফিলতির অভিযোগে বিক্ষোভ শুরু হয়। জনগণ সরকারের কর্তব্যবোধ ও জবাবদিহিতার ব্যাপারে তীব্র হতাশা নিয়ে রাস্তায় নামে।
গ্রীসেও সরকারি অবহেলার অভিযোগে জনগণ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে। দেশটিতে একটি ট্রেন দুর্ঘনার পর সরকার তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেনি। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে মানুষ বিক্ষোভ করতে শুরু করে।
অন্যদিকে মন্টিনিগ্রোতে গত জানুয়ারিতে একটি গণহত্যা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। এ ছাড়া উত্তর ম্যাসেডোনিয়ায় একটি নাইট ক্লাবে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারের দুর্নীতি ও অবহেলার অভিযোগে বিক্ষোভ করে সাধারণ মানুষ।
যুক্তরাষ্ট্রেও সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসননীতি ও গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের অপসারণ করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কয়েকটি শহরে ছোটখাট বিক্ষোভ হয়েছে।
গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে ব্রাজিলে, ফিলিপাইনে, দক্ষিণ কোরিয়ায় ও রোমানিয়ায় বিক্ষোভ হয়েছে।
গত ছয় মাস ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব বিক্ষোভ হচ্ছে। বেশির ভাগ দেশেই দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাসীনেরা গণতন্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় করে ক্রমশ স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছেন। ফলে, জনগণ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছেন। তারা সরকার পরিচালনার ব্যবস্থায় গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতা চান।
এসব বিক্ষোভের সাফল্য হচ্ছে, এখন পর্যন্ত সার্বিয়ার প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। দেশটিতে হয়তো এখন আগাম নির্বাচন হবে।
তবে বিক্ষোভগুলো একটিই বার্তা দেয়, তা হচ্ছে স্বৈরাচারীরা যতই নির্বাচিত হোন না কেন, তারা ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে যতই দৃঢপ্রতিজ্ঞ হোন না, তাদের টিকে থাকার পথ মোটেও সহজ নয়।