বিজ্ঞাপনের কল্যাণেই ইন্টারনেটের বিবিধ ওয়েবসাইট ও সেবা সচল থাকে। সরাসরি ব্যবহারকারী বা ভিজিটরদের কাছে মূল্য দাবি না করে বরং তাদের বিজ্ঞাপন দেখিয়ে সেখান থেকেই আয় করে থাকে ওয়েবসাইট ও সেবার মালিকরা। শুরুতে ওয়েবসাইটের মধ্যে কলাম হিসেবে বা ভিডিওর শুরুতে কয়েক সেকেন্ডের অ্যাডেই সেটি সীমাবদ্ধ থাকলেও আজ বিজ্ঞাপনের উৎপাত এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে কিছু ওয়েবসাইটে প্রবেশ করাই দায়। ক্লিক করলেই আপত্তিকর বিজ্ঞাপনের পাতায় নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে নোটিফিকেশন হিসেবে ফোনে একের পর এক অ্যাড পাঠানো হয়ে দাঁড়িয়েছে নৈমিত্তিক ঘটনা।
বিজ্ঞাপন বন্ধের কিছু তরিকা প্রায় সবারই জানা। আজকের আয়োজন পিসির ব্রাউজার থেকে ফোনের অ্যাপ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিভাবে বিজ্ঞাপন রোধ করা যায় এবং প্রতিটি উপায়ের ভালো ও খারাপ দিকের আলোচনা নিয়ে।
বিজ্ঞাপনের ধরন ও উৎপত্তি
ওয়েবসাইটে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় লেখা ও অন্যান্য কনটেন্টের মধ্যে বসানো বিজ্ঞাপন। তার সঙ্গে আছে ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা মাত্র পুরো স্ক্রিনজোড়া ওভারলে অ্যাড এবং পাতার ওপরে ও নিচে থাকা ব্যানার অ্যাড।
বেশ কিছু ওয়েবসাইটের মালিকরা ব্যানার অ্যাডের মধ্যে নিজ থেকেই প্লে হবে এমন ভিডিও অ্যাডও বসিয়ে থাকে। এর সঙ্গে আছে ওয়েবসাইটের যেকোনো জায়গায় প্রথমবার ক্লিক করলে ব্রাউজারে নতুন ট্যাবে বিজ্ঞাপনের সাইট খোলা, বা স্ক্রল করার মধ্যে আবারও ওভারলে অ্যাড বসানো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের বাড়াবাড়ি দেখা যায় ভিডিও বা গান ডাউনলোড করার ওয়েবসাইটগুলোতে। প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনগুলোর উৎস বিভিন্ন অ্যাড এজেন্সি, যার মধ্যে গুগল অ্যাডসেন্স অন্যতম।
মালিকরা তাদের ওয়েবসাইটের ওপর অ্যাডগুলো বাড়তি অংশ হিসেবে বসিয়ে থাকে। এ ধরনের অ্যাড ব্লক করা কিছুটা সহজ। কেননা মূল ওয়েবসাইটের সূত্র থেকে অ্যাডগুলো হাজির হয় না, বিজ্ঞাপনের সার্ভার থাকে আলাদা। সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের সার্ভারগুলো ব্লক করে দিতে পারলেই অ্যাড আর লোড হবে না।
ভিডিওর শুরুতে বা মধ্যখানে বসানো বিজ্ঞাপন বন্ধ করা একটু কঠিন।
মূল সার্ভার থেকেই সরাসরি বিজ্ঞাপনগুলো ভিডিওর মধ্যে বসিয়ে এরপর দর্শকের পিসি বা ফোনে পাঠানো হয়, তাই আলাদা করে সার্ভার ব্লক করে সেসব বিজ্ঞাপন সরানো যায় না। তবে কিছু বিজ্ঞাপন আলাদা অ্যাড এজেন্সির সার্ভার থেকে হাজির হয়, যেগুলো বন্ধ করা সহজ।
আজকাল বেশির ভাগ ব্যবহারকারীই জানে, গুগল ক্রোম বা মজিলা ফায়ারফক্সে অ্যাডব্লক বা অ্যাড-অ্যাওয়ের মতো এক্সটেনশন ইনস্টল করেই প্রায় সব বিজ্ঞাপন বন্ধ করা যায়। কিছু ব্রাউজার, যেমন—অপেরা জিএক্স বা ভিভালডি ব্রাউজারে অ্যাডব্লকার ইনস্টল করাই থাকে। তবে গুগল বলছে, আগামী দিনে ক্রোম ব্রাউজারে আর তারা অ্যাডব্লকার ইনস্টল করতে দেবে না। সে ক্ষেত্রে অপেরা, ভিভালডি, ক্রোমিয়াম বা ফায়ারফক্স ব্যবহার করা যেতে পারে। অ্যাড বন্ধ করার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এক্সটেনশন বলা যায় ইউব্লক অরিজিন। অ্যাডব্লক বা অ্যাড-অ্যাওয়ের মূল সোর্সকোড পুরোপুরি উন্মুক্ত নয়। তাই সেসব সেবা নিজেই ব্যবহারকারীদের ডাটা চুরি করছে কি না সেটা ধরা কঠিন। ইউব্লক অরিজিন ব্যবহার সম্পূর্ণ ফ্রি এবং এর সোর্সকোড পুরোপুরি উন্মুক্ত, তাই ডাটা চুরি হচ্ছে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। ফায়ারফক্স, অপেরা বা ভিভালডির এক্সটেনশন স্টোর থেকেই সেটি ইনস্টল করে নেওয়া যাবে। ওয়েবসাইট থেকে বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি অন্যান্য ট্র্যাকারও সরিয়ে থাকে ইউব্লক অরিজিন। তবে ভিডিও, যেমন—ইউটিউব থেকে বিজ্ঞাপন সরানোর সেবাটি ইউব্লক অরিজিন বাদ দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে অ্যাডগার্ড ব্যবহার করা যেতে পারে, যদিও ইউটিউবের বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে তাদের প্রিমিয়াম সেবা কিনতে হবে।
স্মার্টফোনে ইউব্লক বা অ্যাডগার্ড ব্যবহার করতে হলে ক্রোম বাদ দিয়ে ফায়ারফক্স ইনস্টল করতে হবে।
পিসি থেকে ব্লক
অ্যাডগার্ড অ্যাপ ইনস্টল করে পুরো পিসিতেই বিজ্ঞাপন বন্ধ করা সম্ভব। বাড়তি পাওনা, ইউটিউব ও অন্যান্য ভিডিও সেবায়ও আর বিজ্ঞাপন দেখা যাবে না। তবে অ্যাডগার্ড ব্যবহার করতে তাদের প্রিমিয়াম সেবা কিনতে হবে। একইভাবে অ্যাডলক বা সার্ফশার্ক ক্লিনওয়েব ব্যবহার করেও বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া যাবে রেহাই। এসব সেবা সরাসরি পিসির ইন্টারনেট সংযোগ থেকেই বিজ্ঞাপন ফিল্টার করে থাকে, তাই ব্রাউজারে বা অন্যান্য অ্যাপে বিজ্ঞাপন ঠেকানোর তরিকার প্রয়োজন থাকে না।
স্মার্টফোনেও অ্যাডব্লক
প্রচুর অ্যানড্রয়েড ও আইওএস অ্যাপে রয়েছে বিরক্তিকর পরিমাণ বিজ্ঞাপন। সেগুলো বন্ধ করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ফোনে অ্যাডব্লক ডিএনএস ব্যবহার করা। ইন্টারনেটে কোন সার্ভারে কী আছে সেটা জানানোর জন্য ডোমেইন নেম সিস্টেম (ডিএনএস) সার্ভার ব্যবহৃত হয়। স্মার্টফোন, পিসি বা রাউটার—সব কটি ডিভাইসই ডিএনএস সার্ভারের মাধ্যমে ইন্টারনেটের ওয়েবসাইট ও সেবাদানকারী সার্ভারের খোঁজ বের করে থাকে। স্মার্টফোনকে যদি বিজ্ঞাপন ফিল্টারসহ ডিএনএস ব্যবহার করতে বলা হয়, তাহলে বিজ্ঞাপন আর লোড হবে না কোনো অ্যাপেই। সেটা ব্রাউজারই হোক বা অন্য কোনো কিছু। অ্যানড্রয়েডে কাজটি একেবারে সহজ। সেটিংসে প্রবেশ করে মোর কানেকশনস অপশনে গিয়ে প্রাইভেট ডিএনএস চালু করে সেখানে বিজ্ঞাপনরোধী সার্ভারের ঠিকানা, যেমন—dnsforge.de বা https://dns11.quad9.net/dns-query বসিয়ে দিলেই হবে। আইফোনের ক্ষেত্রে অ্যাডগার্ড বা অ্যাডব্লক অ্যাপ ডাউনলোড করে চালু করে নিলেও বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া যাবে নিস্তার। ডিএনএস পর্যায়ে বিজ্ঞাপন বন্ধ করলে কোনো অ্যাপের মধ্যেও আর বিজ্ঞাপন দেখা যাবে না। তবে ইউটিউব বা অন্যান্য ভিডিও সেবায় এভাবে বিজ্ঞাপন বন্ধ করা যাবে না।
রাউটার থেকেই বিজ্ঞাপন বন্ধ করা
কিছুটা প্রযুক্তিজ্ঞান থাকলে সরাসরি রাউটারেই বিজ্ঞাপনরোধী ডিএনএস বসানো সম্ভব। এতে ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কে থাকা প্রতিটি ডিভাইসেই বিজ্ঞাপন বন্ধ করা যাবে। সে ক্ষেত্রে ওয়াই-ফাই রাউটারের সেটিংস থেকে ডিএইচসিপি অপশনটি বের করে সেখানে ডিএনএস হিসেবে অ্যাডব্লকার ডিএনএস, যেমন—১৭৬.৯.৯৩.১৯৮ বা ১৭৬.৯.১.১১৭ বসিয়ে দিলেই চলবে। এর পর থেকে যেসব ডিভাইস রাউটারটিতে সংযুক্ত থাকবে সেসব ডিভাইসে আর বিজ্ঞাপন দেখা যাবে না।
পাই-হোল
পাই-হোল তৈরি হচ্ছে সবচেয়ে জটিল উপায়। সাধারণত র্যাস্পবেরি পাই সিঙ্গলবোর্ড কম্পিউটার ব্যবহার করে সিস্টেমটি তৈরি করা হয়, তাই নাম দেওয়া হয়েছে পাই-হোল। পাই-হোল ব্যবহারের বড় সুবিধা হলো তৃতীয় পক্ষীয় ডিএনএস সেবা ব্যবহার না করে পাই-হোল ডিভাইসকেই নিজস্ব ডিএনএস হিসেবে ব্যবহার করে অ্যাড ব্লক করা যায়। এতে নিজের তথ্য যেমন থাকে সুরক্ষিত, তেমনই কখনো বাইরের সেবা বন্ধ বা ব্লক হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। তবে পাই-হোল সেটআপ করা বেশ কঠিন। এ বিষয়ে অনলাইনে প্রচুর গাইডলাইন দেওয়া আছে।
অ্যাডব্লক ব্যবহারের সমস্যা
অনেক সময় অ্যাডব্লক প্রয়োজনীয় ওয়েবসাইটকেও অ্যাড হিসেবে ব্লক করতে পারে। তখন অ্যাডব্লকে সেটি হোয়াইটলিস্ট করে নিতে হবে। বেশ কিছু ব্যাংকিং ও সরকারি ওয়েবসাইটেও অ্যাডব্লক ব্যবহারের কারণে সমস্যা হতে পারে, এসব ক্ষেত্রে অ্যাডব্লক পুরোপুরি বন্ধ করে নেওয়া উচিত। ইউটিউব সরাসরি অ্যাডব্লক ব্যবহারকে ইউটিউব ব্যবহারের চুক্তি ভঙ্গ হিসেবে ধরে থাকে, সেটাও মাথায় রাখতে হবে।