২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর থেকে চলতি বছরের ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও ধর্মকে পুঁজি করে দেশজুড়ে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের চিত্র একই।আন্দোলনের নামে ধারাবাহিক এই সহিংসতার পেছনে ছিল দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা এবং সরকার উৎখাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্র।
সরকার বিরোধী বিভিন্ন দলের অর্থায়নসহ সার্বিক সহযোগিতায় তাদেরই এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। হেফাজত নেতারা মনে করতেন, সরকার পতন হলে তাদের সহায়তা ছাড়া কেউ রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পারবে না। হেফাজতে ইসলামকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে বার বার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে মাদ্রাসাছাত্রদের।
হেফাজতের ইসলামের সদ্য বিলুপ্ত কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কয়েকজন নেতাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। ধারাবাহিক এই জিজ্ঞাসাবাদে সরকার বিরোধী জামায়াত-বিএনপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে হেফাজতের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে কর্মসূচির মাধ্যমে সরাসরি সরকার পতনের ষড়যন্ত্র করেছিল হেফাজতে ইসলাম। আর এই ষড়যন্ত্রে হেফাজতের সঙ্গী ছিল তৎকালীন বিরোধী দল জামায়াত-বিএনপি জোট।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, ৫ মে ওই কর্মসূচির আগে দফায় দফায় বৈঠক করেন হেফাজত ও বিএনপি নেতারা। হেফাজত নেতা আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও গোপন বৈঠকে বসেছিলেন।
এছাড়াও বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকাসহ জামায়াতের অনেকের সঙ্গে বৈঠক হয় হেফাজত নেতাদের। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় হেফাজতের ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়ন না হলে সরকার পতনের আন্দোলন করা হবে। সে অনুযায়ী ৫ মে’র তাণ্ডবে বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরের কর্মীরা জড়িত ছিলেন।
এর একটি বৈঠকে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির জন্য হেফাজতকে মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হয়। টাকার একটি বড় অংশ দেন খালেদা জিয়ার তৎকালীন উপদেষ্টা ও ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টু।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে এর আগে আবদুল আউয়াল মিন্টুর সঙ্গে হেফাজতের বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেন হয়েছে। তথ্য-উপাত্ত এবং তদন্তে এ বিষয়ে আরও অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে। তদন্তে যথাযথ তথ্য বেরিয়ে এলে সে অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডিবির আরেক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে’র ষড়যন্ত্রে কারা কারা অংশ নিয়েছিলেন এবং কারা কারা এর পেছনে ছিলেন তাদের নাম আমরা পেয়েছি। হেফাজতকে যারা রসদ জুগিয়েছিল সরকার বিরোধী সেইসব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দর নাম বেরিয়ে আসছে।
মামুনুলের দুই অ্যাকাউন্টে সাড়ে ৬ কোটি টাকা লেনদেন
হেফাজতে ইসলামের সবচেয়ে আলোচিত নেতা মামুনুল হকের দুই অ্যাকাউন্টে সাড়ে ছয় কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এর একটি অ্যাকাউন্টে ৪৭ লাখ এবং আরেকটি অ্যাকাউন্টে প্রায় ছয় কোটি টাকার লেনদেন হয়। হেফাজতকে এখনো আর্থিক সহায়তা করছে এমন ৩১৩ জনকে ইতোমধ্যে শনাক্ত করা গেছে।
বাবরি মসজিদের নাম করে ভারত বিরোধী বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করেছেন মামুনুল হক। এর মধ্যে বিশেষ করে তার মোবাইলে কাতার, দুবাই, পাকিস্তানসহ অনেক দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ টাকা আসতো। যেসব টাকা সহিংসতায় ব্যয় করা হতো।
বাবুনগরীর ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে শফীকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা
হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও এর বিলুপ্ত কমিটির অনেক নেতৃবৃন্দই ছিলেন জামায়াত-শিবিরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সংশ্লিষ্ট। এর ফলে নিজেদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে হেফাজতকে ব্যবহার করেন তারা। সর্বোপরি সরকার পতনের স্বপ্ন থেকেই তারা হেফাজতের সাবেক আমির আল্লামা শফীকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন।
হেফাজতে ইসলামের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর ছেলের বিয়েতেই শফীকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়। ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে মামুনুল হক, জুনায়েদ আল হাবিবসহ কয়েকজন নেতার বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে নিজেদের ইচ্ছা বাস্তবায়নে আল্লামা শফীকে সরিয়ে বাবুনগরীকে আমির করার পরিকল্পনা হয়।
মামুনুলের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা
ভগ্নিপতি নেয়ামত উল্লাহর মাধ্যমে পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হয় মামুনুলের। ২০০৫ সালে তিনি পাকিস্তানে যান এবং সেখানে ৪০ দিন অবস্থান করেন। পরে জঙ্গি ও উগ্রবাদী মতাদর্শ নিয়ে দেশে ফেরেন। দেশে এসে বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা, অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটান।
পাকিস্তানের ‘তেহেরিক-ই-লাব্বায়িক’ নামের সংগঠনের আদলে তারা হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশকে গঠন করে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো এ দেশকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলো হেফাজত।
গত ১৮ এপ্রিল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদরাসা থেকে মামুনুল হককে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১৯ এপ্রিল তাকে একটি মামলায় সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। ২৬ এপ্রিল তাকে আদালতে হাজির করে অন্য দুই মামলায় আরও সাত দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানকে ঘিরে গত ২৬ ও ২৭ মার্চ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালানো হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবে ১৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া, থানাসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সারাদেশে শতাধিক মামলায় প্রায় এক হাজার জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। মামুনুল হকসহ হেফাজতের নেতৃত্ব পর্যায়ের অন্তত ১৫ জনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।