প্রায় নয় বছর ধরে খুলনা শহরে ইজিবাইক চালান জয়নাল গাজী। এর আগে রাজমিস্ত্রির কাজ করেছেন বছর কয়েক। তবে সে কাজে আর্থিক স্বচ্ছলতা না আসায় ইজিবাইক চালকের পেশায় যুক্ত হন। এ কাজ করেই বাড়িতে তিন কামরার পাকাঘর তুলেছেন, ছেলেকে ভর্তি করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইজিবাইক চালাতে খুব একটা খারাপ লাগে না তার। প্রতিদিন সকালে নগরীর হরিণটানা এলাকায় অবস্থিত নিজের বাড়ি থেকে ইজিবাইকটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। দুপুরে বাড়ি ফিরে খাবার খেয়ে বিশ্রাম শেষে ইজিবাইক নিয়ে আবার সন্ধ্যা পর্যন্ত যাত্রী খুঁজতে থাকেন। সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফিরে মা-বাবা আর স্ত্রী-সন্তানের সাথে সময় কাটান। প্রায় এভাবেই দিনগুলো কাটছিল তার। তবে বিগত দুই মাস ধরে ইজিবাইক চালানোর সময় এবং বাড়ি ফেরার পর কেমন যেনো দম বন্ধ হয়ে আসার অনুভূতি হয় তার, বুকে হালকা ব্যাথার সাথে কাশিও হয়। ইদানিং শহরের রাস্তায় ধুলাবালি অনেকটা বেড়েছে এজন্যই এরকম হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
তবে আজ দুপুরে ইজিবাইক চালানোর সময় বুকব্যাথা-শ্বাসকষ্টের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে অন্য ইজিবাইক চালকেরা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান জয়নাল কে। নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট দেখে ডাক্তার জানান, তার ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ(সিওপিডি) হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে। এটি হলো ফুসফুসের রোগ যা একজন ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। সিওপিডি-তে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে অসুবিধা হয় এবং রোগের প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে দৈনন্দিন কাজ করাও অনেকাংশে কঠিন হয়ে যেতে পারে। সিওপিডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের এমফিসেমা, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস বা উভয়ই হতে পারে। এমফিসেমা হলো ফুসফুসের অ্যালভিওলি বা বায়ু থলির ক্ষতি। অ্যালভিওলি ঠিকভাবে অক্সিজেন শোষণ করতে অক্ষম হলে ফুসফুসের ভেতরে বাতাস আটকে দেয়, যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। আর দুরারোগ্য ব্রঙ্কাইটিস এমন অবস্থা যেখানে ফুসফুসে শ্লেষ্মা তৈরি হয় এবং ফুসফুস তা বের করতে পারে না।
যেহেতু জয়নাল ধূমপান করেন না, সেহেতু বায়ু দূষণের কারণেই তার রোগটি হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা যায়। ডাক্তার আরো জানান, যেসব এলাকায় বায়ু দূষণের মাত্রা অনেক বেশি সেসব এলাকায় দীর্ঘদিন অবস্থান করা, মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর গ্যাস, পার্টিকুলেট ম্যাটার, ওজোন এবং অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাসের কারণে মানবদেহে রোগটি বাসা বাঁধতে পারে। এছাড়া দুর্বল বায়ু চলাচলযুক্ত বাড়িতে রান্নায় কাঠ-কয়লার মতো কঠিন জ্বালানী পোড়ানোর ফলে অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণেও রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। রাজধানী শহর ঢাকাও এখন তীব্র বায়ুদূষণের কবলে পড়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকার প্রথম দিকেই থাকছে শহরটি। গত ১০ ফেব্রুয়ারি বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে নেতিবাচক শহরগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে অবস্থান নেয় রাজধানী ঢাকা। এইদিন সকাল নয়টা নাগাদ আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউ-এয়ার থেকে এ তথ্য জানা যায়। সেদিন বায়ু দূষণের তালিকায় শীর্ষে থাকা ঢাকার স্কোর ছিল ৫৪১। অর্থাৎ এখানকার বাতাসের মান নাগরিকদের বসবাসের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একই তালিকায় ২৭১ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলো ভারতের কলকাতা। এছাড়া, ২৬১ স্কোর নিয়ে তৃতীয় স্থান পায় ভারতের রাজধানী দিল্লি। অর্থাৎ এখানকার বাতাসের মানও নাগরিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স(একিউআই) স্কোর শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত ভালো বায়ুমান নির্দেশ করে। ৫১ থেকে ১০০ পর্যন্ত স্কোর মাঝারি এবং ১৫১ থেকে ২০০ স্কোর হলে তাকে অস্বাস্থ্যকর বায়ু বলে ধরে নেওয়া হয়। পাশাপাশি ২০১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে থাকা একিউআই মানকে খুব অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ এবং অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে থাকা এবং অন্যদের বাড়ির বাইরে কম যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়া ৩০১ থেকে ৪০০ এর মধ্যে থাকা একিউআই মান নগরের বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট পরিচালিত এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(ডবিøউএইচও) এর নির্ধারিত সর্বোচ্চ সহনীয় দূষণমান পাঁচ মাইক্রোগ্রাম। তবে বাংলাদেশের বাতাসে দূষণকারী এসব গ্যাসীয় কণার উপস্থিতি তার চাইতে ১৪ থেকে ১৬ গুণ বেশি। ডবিøউএইচও’র মতে, বায়ু দূষণের কারণে মানুষের স্ট্রোক, হৃদরোগ, সিওপিডি, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং তীব্র শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে। দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। একই সাথে কমে যায় মানুষের গড় আয়ু। দূষণের ফলে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় সাত বছর কমে যাচ্ছে। এলাকাভেদে এই পরিস্থিতি আরও করুন ও ভয়াবহ। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে দূষিত এলাকা গাজীপুর জেলায় বসবাসরত মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে গড়ে আট দশমিক ৩ বছর।
পরিবেশ অধিদপ্তরের দৈনিক প্রকাশিত বায়ুমান প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৫ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে খুলনার বাতাসের একিউআই স্কোর ২০০ এর আশপাশে থাকছে, যা মানবদেহের জন্য নিশ্চিতভাবে অস্বাস্থ্যকর অবস্থা বোঝায়। গত ৪ ফেব্রæয়ারি খুলনার বাতাসে একিউআই মান ছিল ১৯৩। জনঘনত্ব ও যানবাহনের চলাচলের সংখ্যারভিত্তিতে শহরের কিছু এলাকার বাতাসের মান আরো খারাপ হতে পারে বলে ধারণা করা যায়। একই সাথে শুষ্কমৌসুম হওয়ায় রাস্তাগুলোয় বেড়েছে ধুলিকণার পরিমাণ। ফলে নগরীর খোলাস্থানগুলোয় দাঁড়ালেই অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে, বাড়ছে শ^াসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি। খুলনায় দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করে এসব বন্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নিলে নগরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি ক্রমেই বাড়তে থাকবে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ এর ৫ ধারায় কোন এলাকার ইকোসিস্টেম সঙ্কটাপন্ন হলে আশুব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা আছে। একই আইনের ৬ ধারায় ক্ষতিকর ধোঁয়া সৃষ্টিকারী যানবাহন পরীক্ষা এবং উক্ত ধারা লঙ্ঘনকারীকে তাৎক্ষণিক সাজা প্রদানের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০২২, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮, ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৮৯ এর কার্যকর প্রয়োগ বায়ু দূষণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আবার ফিরে যাই সেই জয়নাল গাজীর কাছে। ডাক্তার জানিয়েছেন সিওপিডি-তে আক্রান্ত জয়নাল আর কখনোই পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না। সবসময় ধুলোবালি ও দূষণমুক্ত পরিবেশে থাকার চেষ্টা করতে হবে তাকে, অন্যথায় রোগের তীব্রতা বেড়ে ভোগান্তিতে পড়তে হবে। দূষণ বন্ধ না হলে আরও অনেক মানুষ হয়তো জয়নালের মতো পরিণতি ভোগ করবে। নির্মল বাতাসে বুকভরে শ্বাস নেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে নগরীর মানুষেরা।

লেখক- মোঃ আতিকুর রহমান মুফতি, সহকারী তথ্য অফিসার, পিআইডি