গত ২২ বছরে ২৫ বার আগুনে পুড়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন। এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবার অগ্নিকাণ্ডের পর বন বিভাগের তদন্তে আগুন লাগার কারণ হিসেবে মৌয়ালীদের ব্যবহৃত আগুনের কুণ্ডলী, জেলেদের সিগারেট, দাবদাহ, অনাবৃষ্টি, খরা, বন অপরাধে সাজাপ্রাপ্তদের প্রতিশোধমূলক আচরণ, দুষ্কৃতকারীদের দিয়ে বনের মধ্যে আগুন ধরানোকে দায়ী করা হয়। আগুনের স্থায়িত্বের কারণ হিসেবে বিভিন্ন গাছের পাতার পুরু স্তরকেও দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি।
সুন্দরবনের অগ্নিকাণ্ডের অধিকাংশ ঘটনাই ঘটেছে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে। শনিবারেও (৪ মে) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জেই।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের কটকায় একবার, একই রেঞ্জের নাংলী ও মান্দারবাড়িয়ায় দু’বার, ২০০৫ সালে পচাকোড়ালিয়া, ঘুটাবাড়িয়ার সুতার খাল এলাকায় দু’বার, ২০০৬ সালে তেড়াবেকা, আমুরবুনিয়া, খুরাবাড়িয়া, পচাকোড়ালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার, ২০০৭ সালে পচাকোড়ালিয়া, নাংলি ও ডুমুরিয়ায় তিনবার, ২০১০ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১১ সালে নাংলীতে দু’বার, ২০১৪ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১৬ সালে নাংলী, পচাকোড়ালিয়া ও তুলাতলায় তিনবার, ২০১৭ সালে মাদ্রাসারছিলায় একবার এবং ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ধানসাগর এলাকায় একবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালের ৩ মে শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় দুইবার আগুন লাগে। সর্বশেষ চলতি বছরের ৪ মে চাঁদপাই রেঞ্জের আমরবুনিয়া এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে যা এখনো নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। সুন্দরবনের সবক’টি আগুনের ঘটনাই শুষ্ক মৌসুমে। আগের ২৪ বারের অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১০০ একর বনজ সম্পদের (সুন্দরী গাছসহ বিভিন্ন লতা-গুল্ম) পুড়ে যায়।
প্রতিবার অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। পূর্ব সুন্দরবনে বারবার এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বনবিভাগকে দায়ী করেছে পরিবেশ কর্মী ও স্থানীয়রা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বাগেরহাট জেলা সদস্য এম এ সবুর রানা বলেন, ‘বারবার সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনা উদ্বেগজনক। এমন ঘটনা ঘটার কারণও বিগত সময়ে বন বিভাগ চিহ্নিত করেছে। বন বিভাগ যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় এমনটি ঘটছে। বন দফতরের নজরদারির অভাবেই বনের বাস্তুতন্ত্র আজ হুমকিতে। এতে জীববৈচিত্রের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এ জন্য বন বিভাগের কর্মকর্তারা দায়ী। বনকে সুরক্ষিত রাখতে হলে টহল জোরদার করতে হবে। যারা বনের বিভিন্ন সম্পদ আহরণ করে তাদের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। কোন কোন এলাকায় বনজীবীরা ভ্রমণ করছে তাদের ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও সুন্দরবন রক্ষায় সমন্বয়কারী পশুর রিভার ওয়াটারকিপার নূর আলম শেখ বলেন, কিছু অসৎ মাছ ব্যবসায়ীরা বন কর্মীদের সহায়তায় অধিক মুনাফার লোভে বর্ষা মৌসুমে জাল পাতার জন্য মাঠ পরিষ্কারের উদ্দেশ্যে আগুন লাগিয়ে দেয়। পাশাপাশি অদক্ষ মৌয়ালদের জন্য আগুন লেগে যায়। এর দায় কোনোভাবেই বন বিভাগ এড়াতে পারে না। সরকার ও বনবিভাগ সুন্দরবন রক্ষায় আন্তরিক নয়। আন্তরিক হলে বারবার সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটত না।
তিনি আরো বলেন, সুন্দরবনের যে অংশে সর্বশেষ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে সেখানে চলাচলের রাস্তা তৈরি করে রেখেছে অসাধু লোকেরা। সুন্দরবনের গাছ কাটার জন্য এবং পরিবেশ ধ্বংস করার জন্য প্রতিনিয়ত এখান থেকে চলাচল করে। এর থেকে বোঝা যায় এখানে একটি অসৎ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট রয়েছে। বন বিভাগের এসব অজানা থাকার কথা নয়।
সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের মধ্যে এমনি এমনি আগুন লাগতে পারে না। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। হয়তো মাছ শিকারি, বিড়ি, সিগারেট, মধু সংগ্রহ করার জন্য আগুন লাগতে পারে । তবে বিভিন্ন সময়ে আগুন লাগার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশর বাস্তবায়ন জরুরি। যাতে সুন্দবনের আগুনে ক্ষয়ক্ষতি কমবে।
ঢাকাপোস্ট