রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা এলাকার একটি গ্যারেজপট্টিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গতকাল। এতে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে প্রায় ১৭ থেকে ১৮টি গ্যারেজ। অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করছে ক্ষতিগ্রস্ত গ্যারেজ মালিক সমিতি। একই সঙ্গে বন্ধের দিনে গ্যারেজে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের দাবি, প্রায় ৬ মাস আগে শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সারাদেশের গ্যারেজ মালিক সমিতির পিকনিকের দিন নির্ধারণ করা ছিল। এদিন প্রতিটি গ্যারেজের মালিক এবং শ্রমিক গাজীপুরে পিকনিকে ছিলেন। কেউ গ্যারেজে না থাকা এবং চারদিক থেকে আগুন লাগায় সন্দেহের চোখে দেখছেন তারা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চারদিকে বিভিন্ন প্রকারের পোড়া গাড়ি পড়ে আছে। দোকানের পোড়া টিন আর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ জায়গায় জায়গায় স্তূপ হয়ে আছে। এছাড়াও আগুনে পাশে অবস্থিত একটি স’মিল ও সেখানে থাকা বেশকিছু কাঠ পুড়ে গেছে।
এ বিষয়ে খিলগাঁও, শাজাহানপুর, সবুজবাগ, মুগদা এবং রামপুরা অঞ্চলের বাংলাদেশ অটোমোবাইল মালিক সমিতির সভাপতি ও মাসুম অটো ওয়ার্কশপের মালিক মো. মাসুম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছয় মাস আগে থেকে আমাদের পিকনিকের একটা পরিকল্পনা করা হয়। প্রায় তিন মাস আগে থেকে চাঁদা তোলা থেকে শুরু করে সব আয়োজন চলে। এরপর এই মার্কেটের এবং সারাদেশের যত ওয়ার্কশপ মালিক সমিতি আছে, কাল (শুক্রবার) আমরা সবাই পিকনিকে ছিলাম। কেউই এখানে ছিলেন না। কেউ কাজ করেননি, প্রতিটি ওয়ার্কশপ বন্ধ ছিল। আমরা সকালে এখান থেকেই গাড়ি নিয়ে পিকনিকে চলে গেছি। সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমরা খবর পাই গ্যারেজে আগুন লাগছে। পরে সবাই সেখান থেকে দ্রুত যে যার মতো চলে এসেছি। এসে দেখি সব পুড়ে ছাই, কিছুই পাইনি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ২০ বছর যাবৎ এখানে ব্যবসা করছি। বিভিন্ন সময়ে আমাদের মার্কেট বন্ধ থাকে। কিন্তু তখন কেউ না কেউ এখানে থাকতেন। কোনো দিন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু কালকে কেউ ছিলেন না, তখন আগুন লাগলো।’
মো. মাসুম বলেন, ‘এক সাইডে প্রথমে আগুন লাগে। কিন্তু সেই আগুন এক সাইড থেকে ঘুরে ঘুরে আরেক সাইড পর্যন্ত এল (এল শেপ) এর মতো হয়ে গেলো, এটা আমাদের কাছে আশ্চর্যজনক লাগছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে পুড়ে সব ছাই হয়ে গেছে। আমাদের কাছে মনে হয় আগুন লাগলেও এভাবে লাগার কথা না। আমাদের মালামাল পুড়েছে, ক্ষতি হয়েছে, সন্দেহ তো আমাদের হবেই।’
মো. মুন্না নামের আরেক গ্যারেজ মালিক বলেন, ‘বাংলাদেশের যত গ্যারেজ মালিক আছেন, গতকাল আমাদের বার্ষিক একটা পিকনিক ছিল। সারাদেশ থেকে গ্যারেজ মালিকরা গাজীপুর পিকনিকে এসেছিলেন। কালকে এমনিতে শুক্রবার বন্ধের দিন, আবার একুশে ফেব্রুয়ারির বন্ধ, পাশাপাশি আমাদের পিকনিক ছিল। এই কারণে সব মালিক গাজীপুরে ছিলেন। আমরা যখন খবর পাই তখন সঙ্গে সঙ্গে ওখান থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে চলে আসি। এসে দেখে আমাদের সব শেষ।’
তিনি বলেন, ‘ফিরে এসে যারা ছিলেন তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, আগুনটা লেগেছিল এক কর্নারে। ফায়ার সার্ভিসের দুইটা ইউনিট এসে প্রথমে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছিল। কিন্তু পরে আবার এইভাবে আগুন জ্বলে উঠবে সেটা কেউ বুঝতে পারেনি। ফায়ার সার্ভিসের প্রথমে যে দুইটা ইউনিটে এসেছিল তাদের কাছে পানিও শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরে আরও অনেকগুলো ইউনিট এসে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে করতে সবকিছু পুড়ে শেষ হয়ে গেছে।’
মুন্না বলেন, ‘আমাদের গ্যারেজে পাঁচটি গাড়ি ছিল। একটা প্যারাডো গাড়ি, দুইটা এক্স করলা, একটা নোয়া গাড়ি এবং একটা পিকআপ ছিল। এখানে সবগুলো গ্যারেজ মিলিয়ে যতগুলো গাড়ি ছিল এবং যতগুলো যন্ত্রাংশ ছিল তাতে আমাদের ধারণা মোট ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমার গ্যারেজেই দুই কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই গাড়িগুলো মূলত আমাদের না। এগুলো আমাদের কাস্টমারের গাড়ি। আমরা সার্ভিসিংয়ের জন্য এখানে এনেছিলাম। এছাড়া আমাদের প্রতিষ্ঠানে আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল, যত মালপত্র ছিল সবই তো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যাদের গাড়ি সার্ভিসিংয়ের জন্য এনেছিলাম, তাদের কী জবাব দেবো?’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। আমরা অনেক কিছু ধারণা করতে পারি। কিন্তু এই দায়িত্ব প্রশাসনের। তাদের উচিত তদন্ত করে বের করা আগুনটা কীভাবে লেগেছে। আমার ক্ষতি হয়েছে, আমি সে কারণে দোষ দিতে পারি। এখন বাকিটা প্রশাসনের দায়িত্ব। যেহেতু ছয় মাস আগে থেকেই সবাই জানে যে এই দিন মালিকরা কেউ থাকবেন না। পরিকল্পিত একটা পিকনিক ছিল। সেহেতু আমাদের একটা সন্দেহ থাকতেই পারে, এখন প্রশাসনের দায়িত্ব তদন্ত করে আগুনের কারণ খুঁজে বের করা।’
মতিঝিল আঞ্চলিক থানা বাংলাদেশ অটোমোবাইল মালিক সমিতির সভাপতি মো. মুজিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা জানতে পারিনি যে কোথা থেকে আগুনের ঘটনাটা ঘটছে। আমরা যা দেখলাম, এই ওয়ার্কশপ পল্লি যেভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, সবগুলো গ্যারেজ মিলিয়ে প্রায় ১৭টি গাড়ি পুড়ে ছাই হয়েছে। এরপর প্রত্যেকটা ওয়ার্কশপে যেসব যন্ত্রপাতি ছিল, কিছু রি-কন্ডিশন ইঞ্জিনও কেনা ছিল, সব পুড়ে গেছে। ওয়ার্কশপ মালিকরা সবাই পথে বসে গেছেন। প্রত্যেকটা গ্যারেজের মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার রিকন্ডিশন স্পেয়ার পার্টস কেনা থাকে। সেগুলোও সব শেষ। ওয়ার্কশপ মালিকরা যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সরকার যদি এই অসহায় মানুষগুলোর দিকে না থাকায় তাহলে তারা জীবনেও উঠে দাঁড়াতে পারবে না।’
এদিকে নিজের গ্যারেজে রংমিস্ত্রি না থাকায় কাস্টমারের গাড়ি নিয়ে নিজ দায়িত্বে পুড়ে যাওয়া একটি গ্যারেজে রঙের কাজ করাতে রেখে গিয়েছিলেন মায়ের দোয়া অটোমোবাইল গ্যারেজের মালিক হাবিব। তিনি বলেন, ‘আমার গ্যারেজ অন্যদিকে। আমার গ্যারেজে রংমিস্ত্রি না থাকায় এখানে গাড়িটা রং করার জন্য রেখে গিয়েছিলাম। রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারি) ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল। আগুনে পুরো গাড়িটাই শেষ।’
গাড়ির মালিক কিছু বলেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গাড়ির মালিক তো অনেক কিছুই বলবে। কিন্তু তারও তো আমাদের বিষয়টা বোঝা লাগবে। সবার যা হবে এই গাড়ির মালিকের তাই হবে। এখন পুরো গাড়ির ক্ষতিপূরণ চাইলে সেটা কি আমি দিতে পারবো? এই গাড়িটার কাজ করে আমার সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা না হয় লাভ হতো। গাড়ির দাম ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকা। এত টাকা কি দেওয়া সম্ভব?’
নিউ টেকনিক অটোমোবাইলসের মালিক আলম বলেন, ‘আমাদের তো অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি, আমাদের আর কিছুই নেই। আমাদের ওয়ার্কশপ নেই, গাড়ি নেই। কাস্টমারের গাড়ি নেই। এখানে কিছু ডিলারদের গাড়ি ছিল, যারা গাড়ির ব্যবসা করেন, তাদের গাড়িগুলোও নেই। সব শেষ আমাদের। এই আগুনে আমারই ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
এর আগে শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে তালতলা মার্কেটের পাশে গ্যারেজপট্টিতে ভয়াবহ আগুন লাগে। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে গেলেও আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে আসায় দুটি ইউনিট ফেরত পাঠানো হয়। পরে ৯ ইউনিটের চেষ্টায় রাত ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
শুক্রবার রাতে ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার রাশেদ বিন খালিদ বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রথমে তিনটি ইউনিট কাজ করলেও পরে একে একে যোগ দেয় ১১টি ইউনিট। এরপর দুটি ইউনিট ফেরত পাঠানো হয়। এরপর রাত ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
তবে তাৎক্ষণিকভাবে গ্যারেজের পাশে স’মিল থেকে আগুনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হলেও পরে জানা যায়, ওই মার্কেটে একটি টায়ারের গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত। পরে সেখান থেকে আগুন গাড়ির গ্যারেজে ছড়িয়ে পড়ে। গ্যারেজে থাকা বিভিন্ন গাড়িতে আগুন লেগে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়।
আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করতে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাবের সদস্যরা ছুটে আসেন।