খুলনার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের নদী গুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে! রাতা রাতি নদীর মাঝে জেগে উঠছে বালুর দ্বীপ
শতশত বছরের ভদ্রানদী। খুলনার ডুমুরিয়া,বটিয়াঘাটা ও পাইকগাছা উপজেলার গা-ঘেষে বয়ে চলা। অগভীর ছিল এই ভদ্রা নদী। এক সময় শতশত বাড়িঘর,জমি জায়গা, পুকুর,হাজার হাজার বিঘা জমি, লীজঘের,বিলীন হয়ে যায় এই ভদ্রা নদীতে। অনেক পরিবার হয়েছে নিঃস্ব।
কালের পরিবর্তে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে এই সেই রাক্ষসী মায়াবী ভদ্রা নদী। ৩/৪ শ হাত এমনকি কোথাও কোথাও তারও বেশি গভীরতা ছিল এই নদীর তলদেশ। কোন যানবাহন নদীতে তলিয়ে গেলে তা আর খুঁজে পাওয়া যেত না বলে জানিয়েছেন,শত বছরের একাধিক বয়স্ক ব্যক্তিরা। দেশের দক্ষিণ – পশ্চিম অঞ্চল ছিল একমাত্র ব্যবসায়ী কেন্দ্র এই নদী। নদীতে লঞ্চ,স্টিমার সহ বিভিন্ন মালবাহী,পন্যবাহী ভারী নৌযান চলাচল করত এই নদীতে।
ঢাকা থেকে বরিশাল, টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া,পাটুলিয়া থেকে খুলনা, গোপালগঞ্জ টুংগীপাড়া,বাগেরহাট, যশোর, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া,সাতক্ষীরা,থেকে দক্ষিণ অঞ্চল সুন্দরবন কয়রা বেদকাশি,শ্যামনগর,সাতক্ষীরা,আশাশুনি,শ্যামনগর, ঘড়িলাল, বটিয়াঘাটা, দাকোপ,পাইকগাছা,কয়রা, কালাবগী,সুতারখালী,লাউডোব,বিভিন্ন অঞ্চলে এই নদী দিয়ে প্রতিদিন লঞ্চ স্টিমার, ইঞ্জিন চালিত ট্রলার ও টাবুরে নৌকায় করে শত শত যাত্রী চলাচল করত। এই এলাকার একমাত্র চলচলের মাধ্যম ছিল এই সকল যানবাহন। এখন এই নৌ যানবাহন নদীতে আর দেখা যায় না। নদীর নাব্যতা হারিয়ে আজ নদীর মাঝে উঠেছে বিশাল বালুর দ্বীপ। অধিকাংশ নদ-নদী গুলো বালুর দ্বীপে পরিণত হয়েছে। চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এই নদী থেকে সকল প্রকার নৌযান। যার ফলে খুলনার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বিভিন্ন বড় বড় ব্যবসা বাণিজ্য,নিগম,পৌরসভা,উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজার বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আজ বিলুপ্ত হওয়ার পথে। অচিরেই এই নদীর জীবন ফিরিয়ে না আনলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হয়ে যাবে মরুভূমি। দেখা দেবে খাদ্য সংকট সহ নানাবিদ সমস্যা ও দুর্ভিক্ষ।
পাইকগাছা উপজেলার শিবসা নদী বালুর দ্বীপে পরিনত হয়েছে। ভাটার সময় নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ভাটার সময় মানুষ এপার থেকে ওপার হেঁটে পারাপার হয়ে থাকে।
সম্প্রতি বটিয়াঘাটা উপজেলার ভদ্রা নদীর বারোআড়িয়া চৌমুহনা ও গাওঘরা,শরাফপুর, কাঞ্চননগর, উত্তর শৈলমারী,বটিয়াঘাটা ব্রিজ সংলগ্ন নদীতে ভাটার সময় মানুষ নদী থেকে হেঁটে পারাপার হচ্ছে। গাওঘরা – শরাফপূর নদীতে হঠাৎ করে জেগে উঠেছে বালুর দ্বীপ। ভাটার সময় নৌ চলাচল করতে পারছেনা। সাধারণ মানুষ ভাটার সময় নদীতে নেমে নারী পুরুষ, কিশোর – কিশোরীরা আনন্দে উল্লাসে মেতে ওঠে।
গাওঘরা-শরাফপুর খেয়া ঘাটে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে যাত্রী পারাপার করেন খেওয়া মাঝি অরুন দাস। তিনি বলেন, আমার বয়সের অধিকাংশ জীবনটা পার করেছি যাত্রী পারাপার করে। এখন নদীতে ভাটার সময় নৌকা চালানো যাচ্ছে না।
ঘাট ইজারাদার মোঃ শরিফ বলেন,আমি প্রতিবছর খুলনা জেলা পরিষদ থেকে ১২ লাখ টাকা দিয়ে ঘাটটি ইজারা নেই। কিন্তু এবার ঘাটের যে অবস্থা তাতে আমি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবো। যে টাকা দিয়ে ঘাট ইজারা নিয়েছি,সে টাকা বছরের ভিতর তোলা সম্ভব নয়। তাই আমি এবছর ঘাট ইজারা নিয়ে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছি।
বারোআড়িয়া – রায়পুর ঘাট ইজারাদার মোঃ ইবাদুল বলেন, নদীতে জোয়ার থাকলে মানুষ পারাপার হয়। ভাটা হলে কেউ কাদা মেখে নৌকায় উঠতে চায়না। এমনকি ভাটার সময় বালুর চরে নৌকা বেধে যায়। সরকার ঘাট থেকে প্রতিবছর ২/৩ লাখ টাকা ইজারা নিয়ে থাকে।
শত বছরের খুলনার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বারোআড়িয়া হাট বাজারটি আজ নদী-নালা বন্ধ হওয়ার কারণে বিলুপ্ত হতে চলেছে। বাজার কমিটির সভাপতি মিলন কান্তি মল্লিক বলেন,এই বাজারে একসময় ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরের ব্যবসায়ীরা আসতো ব্যবসা করতে। প্রতি শুক্রবারে এই বাজারে সাপ্তাহিক হাট বসে। যেখানে হাজার হাজার লোকের সমাগম ছিল। কিন্তু আজ আর এখানে সেরকম জনসমাগম হয় না। কারণ একটাই যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। নদীগর্ভে বাজারটি হারিয়ে গেছে। তেমনি নদী বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহিরাগত থেকে আসা ব্যবসায়ীরা এখন আর বাজারে আসেনা।
যে কারণে আজ এই ঐতিহ্যবাহী বাজারটি বিলুপ্তের পথে।
বাজারের হাট ঘাট ইজারাদার মোঃ শওকত শেখ বলেন, প্রতিবছর হাট বাজারটি ৩ লাখ টাকায় ইজারা নেই। সরকার মোটা অংকের রাজস্ব পেলেও বাজার উন্নয়নে নেই তেমন কোন অগ্রগতি।
বাংলাদেশ ইঞ্জিন চালিত বাল্ডেট বোর্ড এর খুলনার সাবেক সভাপতি সুশান্ত সরকার বলেন,এখন আগের মতো নদীতে নৌকা চলাচল করতে পারেনা। নদীতে বালু পড়ে অধিকাংশ নদীনালা বন্ধ হয়ে গেছে। যার ফলে এই পেশার মানুষ এখন অন্যপেশায় চলে যাচ্ছে।
হাট বাজার উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নিবার্হী অফিসার মোঃ মমিনুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, নদী নালা যে ভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাতে অচিরেই নৌ চলাচল বন্ধ হওয়ার উপকরণ দেখা দিবে। সরকার নদী খনন ও হাট বাজেরের উন্নয়ন কাজ চলমান রেখেছে। আমি এই সমস্যা গুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলবো।
Leave a comment