বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট স্যাটেলাইট স্টেশন খুলনার সহযোগিতায় এবং ব্রি’র কীটতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে নিরাপদ ফসল ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ধানের সমন্বিত পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা শীর্ষক কৃষক প্রশিক্ষণ ও মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত হয়েছে খুলনার বটিয়াঘাটার সুরখালি গ্রামে।বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক কার্যালয় সাতক্ষীরার প্রধান এবং চীফ সাইন্টিফিক অফিসার (সিএসও) ড. মোঃ সাজ্জাদুর রহমান এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রিন্সিপাল সাইন্টিফিক অফিসার ড. নজমুল বারী। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন ব্রি, স্যাটেলাইট স্টেশন খুলনার সাইন্টিফিক অফিসার এবং প্রধান কৃষিবিদ মোঃ ইফতেখার উদ্দিন জিতু। প্রায় শতাধিক কৃষক বিষমুক্ত ধান চাষের মাঠ দিবসে উপস্থিত হন। এ সময় কৃষকরা মতামত বিনিময় করেন ধান গবেষকদের সাথে।
ধান বিজ্ঞানীরা কীটনাশক ব্যবহারে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে পিএসও ড. মোঃ নজমুল বারী বলেন, ‘প্রয়োজন হলে বিষ দেবেন, না হলে দেওয়ার দরকার নেই। অন্য একজন কৃষক ডিলারের কথা শুনে বিষ দিচ্ছে তার মানে আপনাকেও দিতে হবে এরকমটা করবেন না। ধান রোপনের পর অন্তত ৪০ দিন কোনো কীটনাশক ব্যবহার করবেন না জমিতে।‘এ সময় তিনি বাদামী গাছ ফড়িং বা কারেন্ট পোকার জন্মবৃত্তান্ত, আলোক ফাঁদের সুবিধা-অসুবিধা, বীষ ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক ও ফসলের উপকারী পোকা ও ক্ষতিকর পোকার ছবি প্রজেক্টরের মাধ্যমে দেখান। কীটনাশকের অপকার সম্পর্কে কৃষকদের সচেতন করতে বিভিন্ন গল্পসহকারে কৃষকদের বুঝিয়ে দেন।
অনুষ্ঠানের শেষদিকে প্রশ্নোত্তর পর্বে কৃষকরা নানাবিদ সুবিধা অসুবিধা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি তার সমাধান দেন।জলমা ইউনিয়নের কৃষক আবুল বাশার জানান, ‘আমি বিগত বছরগুলোতে প্রচুর কীটনাশক দিয়েও ভালো ফলন পাইনি। ১০ বিঘা জমিতে প্রায় ২০ হাজার টাকার উপরে কিটনাশক দিয়েও সেভাবে ফলন পাইনি। এবার স্যারদের কথামতো বিষ দেওয়া থেকে বিরত থাকি। যতটুকু না দিলে নয় তার বেশি দেয়নি। এবার আমার ফলন আমার প্রত্যাশার চাইতেও বেশি হয়েছে। আগে যেখানে ৫০ মণ ধান হতো এবার সেই পরিমাণ জমি থেকে প্রায় ৭২ মণ ধান পাব বলে আশা করছি।‘ ‘ক্ষতিকর পোকামাকড়ের হাত থেকে ধান ফসলকে রক্ষার জন্য কৃষকরা নির্বিচারে কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকেন। প্রতি মৌসুমে কৃষকরা মাজরা পোকা, পাতামোড়ানো পোকা, পামরি পোকা, বাদামি গাছফড়িং ও গান্ধিপোকা দমনের জন্য গড়ে তিন থেকে চারবার ধানের জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকেন। কীটনাশক প্রয়োগে একদিকে যেমন মাটি, পানি ও বায়ু বিষাক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে কৃষকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে।
বটিয়াঘাটার আরেক কৃষক মিহির কান্তি বিশ্বাস বলেন, ‘কীটনাশক না দিয়ে অনেক উপকার পাচ্ছি। একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ কমে গেছে সেই সাথে ফলনও অনেক ভালো এখনো পর্যন্ত। আগে অকারণে ডিলারদের কথা শুনে জমিতে কীটনাশক দিতাম এর ফলে জমির উপকারী পোকাও মারা যেতো। এখন কোনো পরামর্শ দরকার হলেই স্যারদের কাছে শুনি ডিলারদের কথামতো কীটনাশক দিইনা।‘জমিতে কীটনাশকের অযাচিত প্রয়োগ বন্ধের কারণে বন্ধু পোকার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে যেগুলো পরবর্তী পর্যায়ে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের ডিম ও লার্ভা খেয়ে দমন করবে। কীটনাশকের ব্যবহার ৫০-১০০% পর্যন্ত কমিয়ে আনা যাবে। বিঘা প্রতি ধান উৎপাদন খরচ সাশ্রয় হবে। কীটনাশকের ব্যবহার কমলে কৃষক ও ভোক্তা দীর্ঘমেয়াদি বিষক্রিয়া থেকে বাঁচবে।
ব্রি, খুলনার সাইন্টিফিক অফিসার এবং প্রধান মোঃ ইফতেখার উদ্দিন জিতু জানান, ‘কৃষকের দ্বারা কিভাবে নিরাপদ ফসল উৎপাদন করা যায় সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আজকাল প্রায়ই গবেষণায় দেখি খাবারে কীটনাশকের প্রভাবে ক্যান্সারের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে, সেই জায়গা থেকে আমাদের লক্ষ্য যত কম সম্ভব কীটনাশক ব্যবহারে অথবা পরিবেশ বান্ধব জৈবিক উপায়ে কিভাবে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। তারই উদ্যোগে আমরা কৃষককে দেখিয়েছি একটি জমিতে তারা কীটনাশক ব্যবহার করবে আরেকটি জমিতে আমাদের কথামতো একেবারেই ব্যবহার করবেন না। এর ফলে তারাও বুঝতে পারছে তারা অধিক কীটনাশক ব্যবহারে সবদিক দিয়েই ক্ষতির সম্মুখীন হতো।
অনুষ্ঠানের শেষে আমন্ত্রিত কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ সরবরাহ করা হয়।