সময়টা ১৯৪৮ সাল। ‘ফোর চিলড্রেন ফর সেল, ভেতরে কথা বলুন’ ছবিটি প্রথম দ্য ভিডেট-মেসেঞ্জার অব ভালপারাইসো, ইন্ডিয়ানা-তে ৫ আগস্ট প্রকাশিত হয়। একজন মা তার চার সন্তানকে বিক্রির জন্য বাড়ির সামনে একটি বোর্ড টানিয়ে রাখেছেন। এক ফটোগ্রাফার যখন ছবিটি তোলেন তখন বাচ্চাদের কিছুটা বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল এবং তাদের গর্ভবতী মা ফটোগ্রাফারের কাছ থেকে তার মুখ লুকিয়ে রেখেছেন।
এই ছবিটি বিশ্ববাসীকে কাঁদিয়েছিল সেসময়। এখনো এই ছবি বিশ্ব এক অসহায় মায়ের আর্তনাথ শোনায় বিশ্বকে। সেই মা ছিলেন লুসিল চ্যালিফক্স। যিনি তার চার সন্তানকে বিক্রি করার জন্য শিকাগোর বাড়ির সামনে সিঁড়িতে বসিয়ে রেখেছেন। তখন তিনি তার পঞ্চম সন্তানের আগমনের দিন গুণছেন। সিঁড়িতে বসে থাকা উপরের ধাপে ৬ বছর বয়সী লানা, পাশে তার বোন ৫ বছর বয়সী রাই, নিচের সিঁড়িতে ৪ ও ২ বছর বয়সী তাদের দুই ভাই মিল্টন এবং সু এলেন।
বিশ্বযুদ্ধের দামামা শেষ হয়েছে সবে, ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বিশ্ব। কিন্তু আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরেনি সবার। লুসিলের পরিবারের অবস্থাও ছিল তেমনই। এরমধ্যে তার স্বামী তাকে ও সন্তানদের রেখে নিরুদ্দেশ হন। তারপর পুলিশি ঝামেলার কারণে বাড়িও ফিরতে পারেননি তিনি। এদিকে চার সন্তান নিয়ে লুসিলের অবস্থা খুবই শোচনীয়। বাচ্চাদের ঠিকমতো খাবার দিতে পারছেন না। তারপর তিনি নিজেও গর্ভবতী। শেষ পর্যন্ত বাচ্চাদের ভালো পরিবার এবং ভালো জীবনের জন্য তাদের অন্য পরিবারে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
শেষ পর্যন্ত তিনটি পরিবার এই ৪ শিশুকে দত্তক নেয়। ৫ বছর বয়সী রাই ও ৪ বছর বয়সী মিল্টনকে জোয়েটেম্যান নামের একটি পরিবার দত্তক নেয়। তবে সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করে ছিল আরও কঠিন দিন। যে পরিবার তাদের দত্তক নেয়, তারা কখনোই নিজের সন্তানের মতো আচরণ করেননি মিল্টন এবং রাইয়ের সঙ্গে। বাড়ির চাকরের মতোই ব্যবহার করা হত তাদের সঙ্গে। ছোট্ট দুই ভাইবোনকে মাঠে কাজ করাতেন সেই পরিবার।
যদিও সেই পরিবারের শুধু রাইঅ্যানকে কেনার উদ্দেশ্যে ছিল, কিন্তু তারা লক্ষ্য করে যে মিল্টন খুব কান্না করছে এবং তাকেও নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা সন্তানদের মানুষের চেয়ে ক্রয়কৃত সম্পত্তি হিসেবেই বেশি বিবেচনা করেছিল। জোয়েটেম্যানরা মিল্টনের নাম পরিবর্তন করে কেনেথ ডেভিড জোয়েটেম্যান রাখেন।
বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পরই বাড়ির কর্তা জন জোয়েটেম্যান মিল্টনকে বেঁধে মারধর করেন। খামারে কাজ করার কথা বলেন। মিল্টন রাজি হয়ে যায়, কারণ সে তখন ছোট্ট মিল্টন জানতই না যে খামারের কাজ কী, কিংবা দাসই বা কী! যদিও বাড়ির কর্তী রুথ জোয়েটেম্যান মিল্টনের বেশ খেয়াল রাখতেন। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিল্টনের উপর অত্যাচারও বেড়েছিল কয়েকগুণ। এক সময় মিল্টন সেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান।
রাইঅ্যানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বেভারলি জোয়েটেম্যান। তাকেও সব সময় বেঁধে রাখা হতো। শারীরিক ও মানসিক নানান নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন রাই। ১৭ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন রাই। তবে কিশোরী বয়সে জন জোয়েটেম্যানের ছেলে ল্যান্স গ্রের দ্বারা গর্ভবতীও হয়ে পড়েন রাই। এছাড়াও ছিল অমানসিক নির্যাতন। তার সন্তানকে অন্য এক পরিবারে দত্তক দিতে বাধ্য হয়েছিলেন রাই।
তাদের ভাই ডেভিড, যিনি ছবির সময় তার মায়ের গর্ভে ছিলেন, তাকে আইনত হ্যারি এবং লুয়েলা ম্যাকড্যানিয়েল দত্তক নিয়েছিলেন। তারা তাদের থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে বসবাস করতেন। ডেভিডও একই রকম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ছোট থেকেই। ভালোবাসাহীন একটি জীবন কাটিয়েছেন ডেভিড। বড় হয়েছেন ক্ষেত খামারের কাজ করে। পাননি বাবাব-মা, ভাই-বোনের ভালোবাসা।
ডেভিড, যিনি বলেছেন যে তার দত্তক পিতামাতা কঠোর কিন্তু প্রেমময় এবং সমর্থনকারী ছিলেন, তার ভাইবোনদের দেখতে এবং বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে তাদের শেকল খুলে দেওয়ার জন্য তার বাইকে চড়ে যাওয়ার কথা মনে পড়ে। তবে তাদের বোন লানা এবং ভাই সু এলেনের সঙ্গে কি ঘটেছিল সে ব্যাপারে তারা কিছুই জানত না।
পরবর্তীতে ২০১৩ সালে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যনে মিল্টন এবং রাইঅ্যানের দেখা হয়। তখন তারা বয়োবৃদ্ধ। এর আগে এক পরিবারে থাকলেও দুই ভাই-বোনকে খুব একটা দেখা করতে দেওয়া হত না। ১৯৯৮ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাদের বড় বোন লানা। সু এলেনও তখন ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত এবং জীবনের শেষ সময়ে এসে পৌঁছেছেন তিনি।
তবে সু এলেন খুব ভালো একটি পরিবার পেয়েছিল। শিকাগোর পূর্ব দিকে ছিল তাদের বাড়ি। খুব আদর ভালোবাসায় বড় হয়েছে তাদের ছোট্ট ভাই। এটা জেনে তারা খুবই খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু এমন সময়ে এসে তারা মিলিত হন যখন তার ভাইয়ের সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তবে তাদের আসল মায়ের ব্যাপারে তারা কিছুই জানতেন না। অভিমানে খোঁজও নেননি বহু বছর।
তবে জানা যায়, লুসিল চ্যালিফক্স তার পাঁচ সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়ার পর আবারো সংসার পেতেছিলেন। সেখানে তার চার কন্যা সন্তান হয়। তবে তিনি তার আগের সন্তানদের বিক্রি করার জন্য অনুশোচনা করতেন। ডেভিড ম্যাকড্যানিয়েল, মিল্টন তার মায়ের প্রতি সব রাগ ক্ষোভ দূর করতে পারলেও অভিমান মুছতে পারেননি রাইঅ্যান।